বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি

সবাই ভুলের মধ্যে আছি না তো?

কথায় আছে, বাংলাদেশের জরিপ অফিস, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি মানুষ যদি কাজকর্মে সঠিক থাকতেন, তাহলে দেওয়ানি আদালতের হাতে তেমন কাজ থাকত না। ডিসি অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, তহশীল অফিস ইত্যাদি জায়গা থেকে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা বা প্রতিকার পেতে মানুষজনকে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব। লিখেছেন কুমিলস্নার বিজ্ঞ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা, যিনি একসময়ে গোপালগঞ্জের ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সোহেল রানা
  ০৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

কয়েকবছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকের শেষ পাতায় রাজবাড়ী জেলার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল নিয়ে 'রায় হয়, কার্যকর হয় না, জেলা প্রশাসন দায়ী' শীর্ষক একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। প্রতিবেদনটিতে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের যে অনীহা ও আমলাতান্ত্রিক আচরণের চিত্র পাওয়া গেছে, তা শুধু রাজাবাড়ীর নয়, কমবেশি সারা দেশেরই প্রতিচ্ছবি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের রায় বাস্তবায়ন না করার যুক্তি বা অজুহাত হিসেবে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের যেসব মন্তব্য ওই প্রতিবেদনটিতে এসেছে তার অধিকাংশই অগ্রহণযোগ্য এবং কোনো কোনোটি স্পর্ধারও বহিঃপ্রকাশ বটে। যেমন- 'জমিসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে নানান জটিলতা থাকে। এ কারণে রায় মেনে খতিয়ান সংশোধন করতে সময় লাগে', কিংবা 'আবেদনকারী ডিক্রিপ্রাপ্ত জমিটি কার দখলে আছে তা স্পষ্ট করেননি। রেকর্ড সংশোধন করতে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়, তাও করেননি। এমন অনেক অসঙ্গতি থাকায় আদালতের রায় মোতাবেক রেকর্ড সংশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না', ইত্যাদি ইত্যাদি।

লা্যান্ড সার্ভে মামলার প্রকৃতি এবং ফলাফলের বৈশিষ্ট্য ও পরিসীমা অনুযায়ী ডিক্রিকৃত মামলার আদেশ হয় স্পষ্ট ও স্বয়ংসম্পূর্ণ; তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদ্যমান রেকর্ডে যান্ত্রিকভাবে কলম চালানো ছাড়া অন্যকোনো বিবেচনা বা চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না বা তা করার সুযোগও নেই। রেকর্ড হালনাগাদ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কালেক্টর অফিস (জেলা প্রশাসন) যদি লা্যান্ড সার্ভে মামলার রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতিরিক্ত কোনো বিবেচনা বা চিন্তা-ভাবনার প্রয়োগ ঘটাতে চান, তাহলে তা হবে 'খুদকারী'র নামান্তর। এমনকি, আদালত অবমাননা বললেও ভুল হবে না।

লা্যান্ড সার্ভে মামলার রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা কেন বলবেন যে, জমিসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে নানান জটিলতা থাকে কিংবা কেনই বা তারা জমির দখলকারের খোঁজ করবেন? তাদের মনে রাখতে হবে যে, তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা রায় দিচ্ছেন না, ট্রাইবু্যনালের প্রদত্ত রায়টি বাস্তবায়ন করছেন মাত্র।

তাছাড়া রেকর্ড সংশোধন করার জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয় মর্মে যে মন্তব্য এসেছে তা-ও সঠিক হতে পারে না। কারণ নির্ধারিত ফরমে আবেদনের বিষয়টি এসএটি অ্যাক্টের ১৪৩ ধারার আওতায় খতিয়ান সংশোধনের সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, ল্যান্ড সার্ভে মামলার ক্ষেত্রে নয়। কারণ এ বিষয়ে আইনেরই ম্যান্ডেট হচ্ছে এমন যে, লা্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের নির্দেশ (যা মামলার রায় বা আদেশের কপি প্রেরণের মাধ্যমে দেয়া হয়) অনুযায়ী রেকর্ড-অব-রাইটস (খতিয়ান ও নকশা) সংশোধিত হয়ে যাবে। আর, চূড়ান্ত হওয়া রেকর্ড যে যে অফিসে সংরক্ষিত থাকে, তার মধ্যে শুধু কালেক্টর বা জেলা প্রশাসকের অফিসেরটিই হচ্ছে পাবলিক কপি অর্থাৎ এটি থেকে মানুষজন অনুলিপি নিতে পারে। ফলে কোনো ল্যান্ড সার্ভে মামলায় রেকর্ড সংশোধনের আদেশ হলে সর্বাগ্রেই জেলা প্রশাসকের উচিত নিজের কাছে থাকা রেকর্ডটি সংশোধন করে ফেলা।

কথায় আছে, বাংলাদেশের জরিপ অফিস, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি মানুষ যদি কাজকর্মে সঠিক থাকতেন, তাহলে দেওয়ানি আদালতের হাতে তেমন কাজ থাকত না। ডিসি অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, তহশীল অফিস ইত্যাদি জায়গা থেকে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা বা প্রতিকার পেতে মানুষজনকে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা সবাইকেই মানতে হবে, বাংলাদেশে জরিপকার্য চলার সময় টাকা-পয়সার লেনদেন একটি প্রতিষ্ঠিত চর্চা। মালিকানা বৈধ হলেও টাকা না দিলে একের জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে যায় কিংবা কোনো না কোনো পঁ্যাচ লাগিয়ে দেয়া হয়। এর বাইরে শারীরিক, মানুষিক ও সামাজিক পরিশ্রম বা হয়রানি তো আছেই।

বিশেষ ব্যতিক্রম বাদে প্রতিটি মৌজার জরিপকার্য শেষও হচ্ছে পাঁচ বছরের জায়গায় ২০-২৫ বছর সময় নিয়ে। বাংলাদেশের রাজস্ব জরিপগুলো বর্তমানে মূলত জোনাল সেটেলমেন্ট পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে, এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্তৃপক্ষের অর্গানোগ্রামে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা-কর্মচারী। চর বা পয়োবৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমির দিয়ারা জরিপগুলোও তাদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, জরিপকার্যের সার্বিক মান দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ভুলে-ভালে ভরপুর রেকর্ডের মধ্যে ছোটখাটো বা মুদ্রনজনিত ভুল তো থাকেই, এমনকিছু ভুল থাকছে যেগুলো ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। বিশেষ করে, দাগসূচির হালসাবেক বিবরণে মারাত্মক তথ্যগত ভুল থাকায় জমির পরিচয় বা ইতিহাস উদ্ধার করার জন্য গলদঘর্ম হতে হয় বা গবেষণার আশ্রয় (নতুন-পুরাতন নকশা টালি করে) নিতে হয়। ছোট বা বড়, জরিপকার্যে যারাই নিয়োজিত আছেন, নিজেদের কাজের জবাবদিহিতার ভয় যদি তাদের থাকতো তাহলে এত বেশি ভুল হতো না। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, জরিপগুলো সম্পন্ন হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারেরই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা এবং এগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত ভুলত্রম্নটি থাকে বলেই প্রতিকার হিসাবে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালগুলো স্থাপিত হয়েছে, অথচ ট্রাইবু্যনালের রায় বাস্তবায়নে আবার তারাই গড়িমসি করছেন!

অনেক সময় ডিক্রি হওয়া কোনো কোনো মামলায় বিচারকরা এমনতর আদেশও দিচ্ছেন যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আসলেই সমস্যা বা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়তে হচ্ছে। যেমন- 'অত্র মামলাটি ১-৪নং বিবাদীদের বিরুদ্ধে দুই তরফায় এবং অন্যান্য বিবাদীদের বিরুদ্ধে এক তরফায় বিনা খরচায় ডিক্রি হয়। রায়ের মর্মানুসারে নালিশা জমিসংক্রান্ত খতিয়ানে বাদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করে খতিয়ানটি সংশোধন করতে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেয়া হলো'। এরূপ দায়সারা ও অসম্পূর্ণ আদেশ দিলে প্রদত্ত ডিক্রি আসলেই ইনফ্রাকচুয়াস হয়ে থাকবে এবং তা বাস্তবায়ন না-করার কারণে কাউকে দোষারোপও করা যাবে না। কারণ, ওই আদেশটি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমে পুরো রায়টি পড়তে হবে এবং কার কার ভাগ থেকে জমি এনে বাদীকে দিতে হবে সেটির জন্য করতে হবে গবেষণা।

লেখক : চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিলস্না

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90887 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1