মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভেজাল, নকল ও মানহীন ওষুধ বন্ধের আইনি ব্যবস্থা কতটুকু শক্তিশালী?

বাংলাদেশে যে পরিমাণ নকল ওষুধ উৎপাদন, মেয়াদহীন ওষুধ পুনঃপ্যাকেটজাতকরণ এবং ভেজাল ওষুধের সয়লাব দেখা যায় পৃথিবীর অনেক দেশে এমন ভয়াবহ ব্যাপকতা দেখা যায় না। যেসব ওষুধ আসল নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয় সেটাই ভেজাল বা নকল ওষুধ। যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয় সেটাই হলো নকল ওষুধ। এসব ওষুধ উৎপাদন এবং যখন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয় সেই পদ্ধতিকে বলা হয় নকল ওষুধ বাজারজাতকরণ
কামরুল হাসান নাজমুল
  ০৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

প্রতিটা মানুষের সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে। প্রতিটা মানুষ চায় সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকতে। আর এই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের জীবনের সঙ্গে চলে এলো যুদ্ধ। এজন্যই আমরা অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হতে মরিয়া হয়ে উঠি এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই এবং ওষুধ সেবন করে থাকি। আর বেঁচে থাকা এবং সুস্থ থাকার সংগ্রামে সেই রোগ নিরাময়কারী ওষুধ যদি হয় ভেজাল, নকল এবং মানহীন? রোগ সারানোর বদলে যদি সেই ওষুধই আরও মৃতু্যর কারণ হয়ে ওঠে? তাহলে আমরা কী সেটা নীরবে সহ্য করব, নাকি কোনো প্রতিকার খুঁজব?

হঁ্যা, অবশ্যই আমাদের নকল ওষুধ বন্ধের প্রতিকার খুঁজে দেখা উচিত, কারা বাংলাদেশকে অসুস্থ করে সামান্য কিছু টাকা কামানোর জন্য মৃতু্যপুরী করতে চায়! ভেজাল ওষুধ কতটা মারাত্মক হতে পারে এ বিষয়ে মোটামুটি সবাই কিছুটা হলেও অবগত। ধরা যাক, আপনার কোনো সংক্রামক রোগ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহার অপরিসীম। জীবাণু দ্বারা দেহের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হলে শরীর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে বা অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হলে জীবাণু দেহকে ধ্বংস করার কাজে লেগে যায়। এর মানে হলো, মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং ফলে মৃতু্য অবধারিত হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে যে পরিমাণ নকল ওষুধ উৎপাদন, মেয়াদহীন ওষুধ পুনঃপ্যাকেটজাতকরণ এবং ভেজাল ওষুধের সয়লাব দেখা যায় পৃথিবীর অনেক দেশে এমন ভয়াবহ ব্যাপকতা দেখা যায় না। যে সব ওষুধ আসল নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয় সেটাই ভেজাল বা নকল ওষুধ। যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয় সেটাই হলো নকল ওষুধ। এসব ওষুধ উৎপাদন এবং যখন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয় সেই পদ্ধতিকে বলা হয় নকল ওষুধ বাজারজাতকরণ।

তবে এটা সত্য যে, আমাদের দেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশের নকল ও ভেজাল ওষুধ কম হলেও কিছুটা পাওয়া যায়। তারমধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তান, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা। পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, বিশ্বের উৎপাদিত প্রায় ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে। যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ভেজাল ওষুধের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যানে বাংলাদেশেও কম যায় না। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল নাগাদ ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃতু্য হয়েছিল। আবার ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে শুধু ভেজাল প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনে ২৮ শিশুর মৃতু্য হয়েছিল।

আসল ওষুধ উৎপাদনের নামে ও চেহারায় নকল উপকরণ দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে যেসব নামে-বেনামে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে তা আরও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার কারণে। প্রতিনিয়ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারির মাধ্যমে হাতেগোনা কিছু ওষুধ বিক্রেতা ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে জরিমানা করে ছেড়ে দিচ্ছে, আবার কিছু মামলাও হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। ওই সব অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী সাময়িকের জন্য থেমে থাকলেও আবার একই পথ অবলম্বন করে।

সেসব কারণে দিন দিন কেন প্রশস্ত হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধের বাজারব্যবস্থা তার মধ্যে রয়েছে (১) ডিজিটাল বিশ্বে ইন্টারনেটের ব্যবহার জীবনচলার পথকে যেমন সহজ করেছে; সেই সঙ্গে ইন্টারনেটের মারাত্মক অপকার রয়েছে। এই ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠান ভেজাল ওষুধ সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিচ্ছে; (২) রাস্তার আশপাশে ছোট-বড় হাট-বাজারে, ছত্রাকের মতো গড়ে ওঠা কিছু ওষুধের দোকান নকল ওষুধ বিক্রয়ের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে; (৩) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২৫-২৬ হাজার রকমের ওষুধ তৈরি হয় যার মধ্যে সরকার মাত্র ৪ হাজার রকমের ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ফলে ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সব জায়গায়। আর এভাবেই আরও বিভিন্ন অভিনব উপায়ে ধীরে ধীরে যেমন বাড়ছে ভেজাল ওষুধের বাজার; তেমনি মানুষের মৃতু্য ঝুঁকিও পালস্না দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে।

দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভেজাল ও নকল ওষুধের পরিসংখ্যান বেশি। দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কম হলে, তখন দেখা যায় নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের মানুষ কঠিন রোগেও দামি ওষুধ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুনাফালিপ্সু কিছু মানুষ কম দামে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দেয়। তাই ভেজাল ও নকল ওষুধের ব্যাপারে সরকারের আরও সজাগ হতে হবে। তেমনি সচেতন হতে হবে প্রতিটা মানুষকে।

চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশালে মৃতু্যদন্ডের বিধান আছে। যদিও আমাদের বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই আমরা দেশের জনগণ যদি নকল ও ভেজাল ওষুধ চিনতে পারি, তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করার সুযোগ পাবো। সুতরাং আমরা চেষ্টা করলে কিছু নিয়মে নকল ওষুধ চিনতে পারব।

যারা সরকারের আস্থাভাজন কতিপয় নেতৃত্বের ভেজালের সুস্বাদু ছায়াতে বসে ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি করছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির আওতায় আনা খুবই জরুরি বিষয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্টের বা ওষুধ আইনের আওতায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা খুবই নগণ্য। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম যে তাতে অপরাধ ও অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আইনকানুন পরিবর্তন করে আরও কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, যাতে আর কেউ কোনো সময় নকল, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সাহস না পায়। সেই সঙ্গে দেশের সব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ওষুধ ও প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ প্রশাসনের নজরে আনতে হবে। তবে মূল কথা হলো, ভেজালের রাজত্বে যতটা সম্ভব নিজে সচেতন থাকাটাই আবশ্যক।

লেখক : আইনজীবী এবং কলামিস্ট।

ই-মেইল : শযহধুসঁষ.ষধ@িমসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70075 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1