হ্যাম্পসটেডের লর্ড লয়েডের ভাষায়, প্রাকৃতিক আইন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা অতীতকাল থেকেই নীতিবিদ্যা, রাজনীতি এবং আইনের ক্ষেত্রে একটি উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিছু কিছু সময়কালে, এর আকর্ষণ ছিল ধর্মীয় এবং অতি প্রাকৃতিক। তবে আধুনিক সময়ে এসে এটি রাজনৈতিক এবং আইনগত আদর্শের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এটি বিদ্যমান আইন এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে যাচাই করার শক্তির পেছনে খুব মূল্যবান সাহায্য জুগিয়েছে।
প্রাকৃতিক আইনব্যবস্থাকে স্বর্গে উত্তোলিত আদর্শব্যবস্থা হিসেবে প্রায়ই স্বীকৃতি দেয়া হয়। যেখানে পজিটিভ ল' বা ইতিবাচক আইন অপূর্ণাঙ্গ। প্রাকৃতিক আইনকে আত্মরক্ষার আইন বলা হয় অথবা তা প্রকৃতির কার্যকর একটি আইন।
অধ্যাপক ডায়াস লিখেছেন- প্রাকৃতিক আইন তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রাচীন সময়ের ইতিহাস রয়েছে, যেমন- খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দী। প্রাকৃতিক আইনের একক কোনো তত্ত্ব নেই, এর অনেক সংস্করণ বা ধাপ আছে। তবে এই আইন তত্ত্বের মতো এতটা মৌলিক আইনগত বা রাজনৈতিক তত্ত্বও নেই। প্রাকৃতিক আইন অনেক তারকা খচিত উজ্জ্বল আইন, যা সব যুগের সব অবদানের উজ্জ্বল সংমিশ্রণ। প্রাকৃতিক আইন শব্দটি বলতে বুঝায় বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জনগণকে নিয়ে অনেক ধরনের জিনিস। যেমন- এমন আদর্শ যা আইনগত বিকাশ এবং প্রশাসনকে নির্দেশ করে। এটি আইনের এমন মৌলিক নীতিগত গুণাবলি, যা হয় এবং ঔচিত্যের গোটা বিচ্ছেদকে ঠেকিয়ে দেয়। পরিপূর্ণ ত্রম্নটিবিহীন আইনকে আবিষ্কার করার পথ বাতলে দেয়। আবার, তা আদর্শ বা পরিপূর্ণ আইনের বিষয়বস্তু নির্দেশ করে।
এসব পার্থক্যের আলোকে একজন লেখককে প্রকৃতিবাদী বা পজিটিভবাদী হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। সাধারণত সেসব লেখকদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। প্রাকৃতিক আইন তত্ত্ব একদিক থেকে পরিব্যাপ্ত এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে একে লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ইতিহাসে দেখা যায়- যুগের পর যুগ, কালে কালে এই তত্ত্বটি সর্বোচ্চ প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে। দুটি সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে তত্ত্বটি খুব উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখেছে, যেমন- অনুচিত আইনের বৈধতা এবং স্বাধীনতার অপব্যবহার। যে কোন বাধা বা সমস্যা মোকাবিলায় প্রাকৃতিক আইন তত্ত্বের আইনজীবীদের সদা প্রস্তুতি তাদের উৎসাহের ফল্গুধারা হিসেবে কাজ করেছে।
ড. ফ্র্যায়েডম্যান একটি বিষয় ঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন। তা হলো- প্রাকৃতিক আইনের ইতিহাস একটি গল্পের মতো। সে গল্প মানবজাতির পরম ন্যায়বিচার এবং এর ব্যর্থতা খোঁজার গল্প। বারবার, প্রাকৃতিক আইনের ধারণাটি কিছু রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তা ছিল একটি আদর্শ অন্বেষণের বাহ্যিক রূপ। সে আদর্শ হোক না পজিটিভ আইন থেকেও উঁচু। এই সমস্যাটি খুব তীব্র এবং সব সময়ের জন্য সমাধানের বাইরেই থাকল। পরিবর্তিত সামাজিক এবং রাজনৈতিক শর্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক আইনের ধারণাতেও পরিবর্তন এসেছে। কেবল যে জিনিসটি অপরিবর্তিত বা ধ্রম্নব হিসেবে আছে, তা হলো- পজিটিভ আইন থেকেও উঁচু এমন কিছুর আকর্ষণ। সেই আবেদন বা আকর্ষণের উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান কর্তৃপক্ষকে যাচাই করা।
প্রাকৃতিক আইন অনেক কাজ পূর্ণ করেছে। রোমানদের সনাতন সিভিল আইনের রূপান্তরের মুখ্য হাতিয়ার ছিল এই আইন। সামন্তবাদী গির্জা এবং জার্মান সম্রাটদের লড়াইকালে উভয়পক্ষীয় অস্ত্র হলো এই প্রাকৃতিক আইন তত্ত্ব।
প্রাকৃতিক আইনের নামেই আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা নিরূপিত হয়েছিল। প্রাকৃতিক আইনের আরেকটি আকর্ষণ ছিল তা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বৈরশাসনের ধারণা থেকে রক্ষা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকমন্ডলী প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মূলনীতিগুলোতে মুগ্ধ ছিলেন। তারা এর সাহায্যে ব্যক্তিগত অপরিসীম অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।
প্রাকৃতিক আইন বিভিন্ন প্রজন্মের জনগণকে তাদের আদর্শ এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে উৎসাহ জুগিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই আইনটি যে কোনো আদর্শ সমর্থনে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাকৃতিক আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী তত্ত্বটি একটি সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন ব্যবস্থার আদর্শ দ্বারা আকর্ষিত হয়েছে। লক এবং পেইনের তত্ত্বের মাধ্যমে প্রাকৃতিক আইন আমেরিকা এবং অন্যান্য আধুনিক সংবিধানে ব্যক্তিবিশেষের দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রাকৃতিক আইনের সূত্রপাত হয়েছে গ্রিক চিন্তাবিদদের হাত ধরে। তারাই এই আইনের আবশ্যক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন দার্শনিক হিরাক্লিটাস। তিনি এই আইনকে পেয়েছিলেন ঘটনার ছন্দে ছন্দে। এই আইনকে তিনি বলেছেন- পুরো বিশ্বের নিয়তি, আদেশ এবং যুক্তি। প্রকৃতি তো কেবল কোনো পদার্থ নয়, তা একটি সম্পর্ক, জিনিসের শৃঙ্খলা বা ধারা। প্রকৃতির ধারার চিন্তা আইনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পরিষ্কার একটি জ্ঞানের চিত্র অংকন করে। এর ফলে আলোকিত গ্রিক মতবাদে (সোফিস্ট) ভিত্তি নির্মিত হয়। এটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বিকশিত হয়েছিল।
ধারণা গঠনে আলোকিত গ্রিক মতবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজ হলো প্রকৃতি এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। ওই সময়ের গোটা দর্শনব্যবস্থাকে তা শাসন করেছিল। যদি গোটা বিশ্বে সর্বজনীন কিছু বৈধ হয়, তবে তো তা প্রকৃতির মাধ্যমেই বৈধ। তা বৈধ হবে সবার জন্য; সেখানে জনগণ এবং সময়ের কোনো ভেদাভেদ হবে না। প্রকৃতি যা নির্ধারণ করে সেটাই সঠিক কর্তৃত্বপূর্ণ। মানুষের স্বৈরশাসনের বিপরীতে প্রকৃতি এসেছে। প্রকৃতি যেন মানুষের বাইরের বাহ্যিক কিছু। এটি বিষয়ের এমন ধারা, যাতে যুক্তি থাকে।