শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিয়ের কাবিননামা সংশোধন

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বনাম বাস্তবতা

কাবিননামার ধারাগুলো বিশেষত ১৮নং ধারাটি দেয়াই হয়েছে বর ও কনের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের মতো করে লেখার জন্য। কাজিদের ইচ্ছা অনুযায়ী লেখার জন্য নয়। কারণ কাবিননামার নিয়মটি বিধিবদ্ধ হয়েছে বর ও কনের স্বার্থ রক্ষার জন্য। সুতরাং তারা কী লিখবে এবং কীভাবে লিখবে- এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তারা যা লিখলে এবং যেভাবে লিখলে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল হবে বলে মনে করবে তারা তা-ই লিখতে পারবে। এতে কাজিদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

বিয়ের কাবিননামার ৫নং কলামে মেয়ে কুমারী, বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত কিনা-জানতে চাওয়ার বিষয়টি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা কিংবা কলামটি তুলে দেয়া শরিয়াহ আইনের পরিপন্থি হবে কিনা- সে বিষয়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবের মতামত চেয়েছে হাইকোর্ট। এসংক্রান্ত একটি রিটের জারি করা রুলের শুনানিতে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবকে আগামী ২২ জুলাই হাজির হয়ে এ বিষয়ে মতামত দিতে বলেছে আদালত। এর আগে ২০১৪ সালে কাবিননামার ৫নং কলামের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বস্নাস্ট)।

এবার জেনে নেয়া যাক কাবিননামা কি? বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করা আবশ্যক। ওই আইনে বিবাহ নিবন্ধন না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার নির্ধারিত কাজীকে দিয়ে নির্ধারিত ফরমে বিবাহের নিবন্ধন করতে হয়। যে ফরমে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করা হয় সেটিকে 'নিকাহনামা' বলা হয়, যা 'কাবিননামা' নামেই সমধিক পরিচিত।

উক্ত নিবন্ধন ফরমে মোট ২৪টি ধারা রয়েছে। এসব ধারায় মৌলিকভাবে যে বিষয়গুলো আছে তা হলো, বিবাহের ও নিবন্ধনের স্থান ও তারিখ, স্বামী-স্ত্রীর নাম, পরিচয় ও বয়স, সাক্ষী ও উকিলদের নাম ও পরিচয়, দেনমোহরের পরিমাণ এবং তা নগদ ও বাকির হিসাব, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অধিকার প্রদান ও শর্তসমূহের বিবরণ, কাজীর স্বাক্ষর ও সিলমোহর ইত্যাদি। বর-কনের ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর বিবাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী উপরোক্ত তথ্যগুলো দিয়ে কাবিননামা ফরম পূরণ করেন। ফরম পূরণ শেষে বর ও কনে তাতে স্বাক্ষর করেন।

তবে কাবিননামার এসব ধারার মধ্যে স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো, ১৮নং ধারাটি। অনেক ক্ষেত্রে কাবিননামার ১৮নং ধারাটি পূরণ না করে ফাঁকা রেখে দেয়া হয়। এটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে যে ৯টি কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতির কথা বলা আছে তার কোনোটি না থাকলে এবং খোলার মাধ্যমেও স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ না পেলে একজন স্ত্রীর পক্ষে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কাবিননামার ১৮নং ধারায় স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ না করে তাহলে স্ত্রী নিজে তালাক গ্রহণ করতে পারে না। অথচ স্বামীর প্রতারণা বা জুলুমের কারণে স্ত্রীর কখনো তালাক গ্রহণের মাধ্যমে নিজ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রয়োজন হয়।

প্রকাশ থাকে যে, আমাদের দেশের কাবিননামার উক্ত ধারার ভাষ্যটিও সঠিক নয়। কেননা তাতে লেখা আছে, 'স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে কিনা? করিয়া থাকিলে কি কি শর্তে? সম্ভবত এখান থেকেই উক্ত ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, স্বামী স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দিলে স্ত্রী স্বামীকেই তালাক দিতে পারে। এখানে কথাটা এভাবে লেখা উচিত ছিল যে, 'স্বামী স্ত্রীকে নিজ নফসের উপর তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করিয়াছে কিনা? অথবা এভাবেও লেখা যেত, 'স্বামী স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করিয়াছে কি-না?' পারিবারিক আদালতের এ বিষয়টি আমলে নেয়া উচিত।

কাবিননামার ধারাগুলো বিশেষত ১৮নং ধারাটি দেয়াই হয়েছে বর ও কনের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের মতো করে লেখার জন্য। কাজীদের ইচ্ছা অনুযায়ী লেখার জন্য নয়। কারণ কাবিননামার নিয়মটি বিধিবদ্ধ হয়েছে বর ও কনের স্বার্থ রক্ষার জন্য। সুতরাং তারা কী লিখবে এবং কীভাবে লিখবে- এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তারা যা লিখলে এবং যেভাবে লিখলে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল হবে বলে মনে করবে তারা তা-ই লিখতে পারবে। এতে কাজীদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।

১৯নং কলাম পুরুষতান্ত্রিক। স্বামীর তালাক প্রদানের অধিকার খর্ব করা হয়েছে কিনা। চুক্তির কী নমুনা! সব কাবিনেই লেখা আছে, 'না'। অর্থাৎ স্বামী চাইলে যে কোনো মুহূর্তে স্ত্রীকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারেন। কী বৈষম্য!

এবার আসল কথায় আসি। ৫নং কলামে কন্যা কুমারী, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা কিনা জানতে চেয়েছে। মেয়েটির বৈবাহিক অবস্থান জানতে চেয়েছে দলিল, কিন্তু ছেলেটির নয়। কেন? ছেলেটি কি কুমার বা বিপত্নীক বা তালাকদাতা/প্রাপ্ত হতে পারে না? এটা নিয়েই যত গন্ডগোল।

১১নং কলামটি বিবাহের সাক্ষীর কথা বলা আছে। এখানে পরিষ্কার করে বলাই হয়নি বিয়ের কোন পক্ষের সাক্ষীদের নাম, ও ঠিকানা?

১৩নং কলাম দেনমোহরানাসংক্রান্ত। দেনমোহর কত ধার্য হলো তা লেখা থাকে। মুসলিম শরিয়াহ আইন দেনমোহরানা বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছে, একটি মেয়ের দেনমোহরানা তার অধিকার। এটি একটি মেয়ের রাইটস, প্রিভিলেজ নয়। সেটি নির্ধারিত হবে মূলত মেয়েটির সামাজিক মর্যাদার পাশাপাশি মা-বোন-ফুপুদের দেনমোহরানার বিষয়টি মাথায় রেখে। পাশাপাশি মেয়েটির নিজস্ব কিছু যোগ্যতাও এখানে একটি বড় মাপকাঠি। কিন্তু আদৌ কোনো পক্ষ বিষয়টি মেনে বা ভেবে দেনমোহরানা নির্ধারণ করেন কি? দেনমোহর পরিশোধ করতেই হবে। এটি মাফ চাওয়ার বা মাফ করার সুযোগ নেই। স্বামী সেটি পরিশোধ করতে না পারলে বা মারা গেলে এই ঋণ পরিশোধের দায় ইসলাম স্বামীর বাবা থেকে স্বামীর ছেলের ওপর বর্তিয়েছে। সুতরাং এখানে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে কি কোনো নারীই এই শুভংকরের ফাঁকিতে পড়ে না?

১৬নং কলামে বিশেষ বিবরণে জানতে চাওয়া হয়েছে, চুক্তির পক্ষদ্বয় এর মধ্যে চুক্তিসূত্রে নির্ণীত মূল্যসহ কোনো সম্পত্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধ করা হয়েছে কিনা? খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই ঘরটিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া হয়ে থাকে। কাজী সাহেবরা কি জানেন না সরকারি এই দলিলে কোনো ঘর ক্রস দেয়ার কোনোই সুযোগ নেই?

২০নং কলামে এ বিবাহের সময় দেনমোহর, খোরপোষ বিষয়ে কোনো চুক্তি করা হয়েছিল কিনা সেটি জানতে চাওয়া হয়েছে। এটিই তো বিয়ের চুক্তি। এর আগে-পরে তো আইনে কিছু না। তবে কেন মিছে এই লেখা? এই গুরুত্বপূর্ণ ঘরটিও ক্রসচিহ্ন দিয়ে খালি রাখা হয়েছে। তাহলে আর দরকার কী এসব ঘর রাখার?

২১নং কলামে বরের কোনো বর্তমান স্ত্রী আছে কিনা এবং থাকলে সালিশি পরিষদ থেকে অনুমতি নেয়া হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তার মানে বর্তমানে স্ত্রী থাকলেও তার কোনো মতামতের নাম বা দাম নেই। নারীকে পদে পদে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলা হয়েছে যেখানে সেটি কিসের চুক্তি? মতামতের দাম আছে শালিসি পরিষদের। এই শালিসি পরিষদের কাজটা কি সেটিও আমরা সঠিকভাবে জানি না বা মানি না।

২২নং কলাম জানতে চাইছে অন্য বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার জন্য শালিসি পরিষদের কাছ থেকে বরের অনুমতিপত্র নং...। কী ভয়ানক কথা! তার মানে একটি পুরুষকে যতভাবে সম্ভব একাধিক বিয়ে করানোর জন্য এই চুক্তি পক্ষান্তরে উৎসাহিত করছে। কারণ বাংলাদেশে এটি যে সহজলভ্য সেটি কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। চুক্তির-বিশ্বাসের-ভালোবাসার-আস্থার কোনো অবস্থান নেই?

২৩নং কলাম যে ব্যক্তি দিয়ে বিবাহ পড়ানো হয়েছে তার নাম। মুসলিম বিবাহটা পড়ানো হয় মৌলভী সাহেবকে দিয়ে আর নিবন্ধন করা হয় কাজী দিয়ে। অথচ কোনো বিবাহর চুক্তিতেই দেখলাম না মৌলভী সাহেবের নাম। আসলে বিয়ের নিবন্ধনের নামে যে ফাঁকির খেলা চলছে সেটি দেখার আসলে কেউ নেই।

২৪নং কলামে বিবাহ রেজিস্ট্রি করার তারিখ লিখতে হবে। আশ্চর্যজনকভাবে যে তারিখে বিবাহর কথা হয়েছে সেই তারিখেই রেজিস্ট্রি। এসবের মানে কী? এর মধ্যে আর কোনো কিছুই ঘটেনি?

২৫নং অর্থাৎ সর্বশেষ কলামে রেজিস্ট্রি ফিস পরিশোধের বিষয়ে জানতে চেয়েছে এবং প্রতিটি কাবিন এই লেখা আছে 'পরিশোধিত'। কে, কাকে, কত টাকা পরিশোধ করল কিছুই উলেস্নখ নেই। এখানে সরকারকে চরম ফাঁকি দিয়ে কাজী সাহেবরা লাখ লাখ টাকা জনসাধারণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর সাব-কাজী রেখে তাদের দিয়ে প্রথমে সাদা কাগজে বর ও কনের বিষয়ে সব কিছু লিখিয়ে নিয়ে তারপর একটি দিনক্ষণ দেখে নিয়ে তারা কাগজ সাপস্নাই দেন।

কাবিননামার কোনো জায়গায় বর ও কনের সামাজিক বিষয় বা অর্থনৈতিক বিষয় অথবা শিক্ষাগত বিষয় প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে শুধু কে কাকে কীভাবে কতটুকু ঠকাতে পারে। পুরো কাজটি করতে মেয়েপক্ষে ও ছেলেপক্ষের লাগে সাক্ষী। যদি কেউ নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করে সে ক্ষেত্রে সাক্ষীদের বিষয়ে কী করণীয়? কাজী সাহেবদের সোজা উত্তর, আমরাই নাম বসিয়ে দিই, কী আর করা?

এই যদি হয় জীবন-মরণের সঙ্গীর সঙ্গে চুক্তির নমুনা, তাহলে তো যে কোনো পক্ষ প্রতি পদেই হেস্তনেস্ত হবেই। এ আধুনিক যুগে বিবাহ নিবন্ধন চুক্তিটি সময়োপযোগী করে তৈরি করতে হবে। সংশোধন করার সময় এসেছে। নইলে এত আয়োজন বৃথা।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<61459 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1