বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার প্রতিকার

কিন্তু আইনটির এই কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সারাদেশে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ আইন কমিশনের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই আইনের অধীনে প্রতি ১০০টির মধ্যে গড়ে মাত্র ১০টি মামলায় সাজা হচ্ছে। বাকি ৯০ ভাগ মামলাই প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিরা খালাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া হিসেবে, ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে ঘটনার কোনো প্রমাণ পায়নি বলে মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি। অথবা ঘটনা মিটমাট হয়ে গেছে বলে মামলা তুলে নেয়া হয়েছে।
অপরাজিতা দেবনাথ
  ২৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

নারী নির্যাতন বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। দেশের ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের অপরাধগুলোর কঠোর শাস্তিবিধানের জন্য সরকার 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০' নামে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছে। পরে এই আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে ২০০৩ সালে প্রণীত হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩। এই আইন দিয়ে যে অপরাধগুলো বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হলো যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃতু্য, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌন পীড়ন, ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানী ইত্যাদি।

এ আইনে বর্ণিত অপরাধগুলোর বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করা হয়েছে, শাস্তির কঠোরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, অপরাধের সংজ্ঞা যথাযথ করার চেষ্টা হয়েছে, অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য করা হয়েছে, জামিন ও নিষ্পত্তির অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এ আইনের অধীনে থানায় মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ আদালতের অনুমতি ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারছে, এই আইনের অধীন সব অপরাধ জামিনের অযোগ্য হওয়ায় অভিযুক্ত সহজে জামিন পাচ্ছে না।

কিন্তু আইনটির এই কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সারা দেশে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ আইন কমিশনের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই আইনের অধীনে প্রতি ১০০টির মধ্যে গড়ে মাত্র ১০টি মামলায় সাজা হচ্ছে। বাকি ৯০ ভাগ মামলাই প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিরা খালাস পাচ্ছে।

বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া হিসেবে, ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে ঘটনার কোনো প্রমাণ পায়নি বলে মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি। অথবা ঘটনা মিটমাট হয়ে গেছে বলে মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। পুলিশ বলছে, এমন প্রচুর মামলা রয়েছে যাতে পরিবারের একজন দোষী হলেও পুরো পরিবারকে জড়ানো হয়েছে।

বিশেষ করে ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামা সম্পাদন করার সুযোগ থাকায় ভুয়া ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের পথ সুগম হয়েছে।

তবে মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের শিকার হলে বিবাদী আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্যদিয়ে প্রতিকার পেতে পারে। আইনটির ১৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান তাহা হইলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করাইয়াছেন উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন।' এছাড়াও, দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দায়েরকৃত নারী নির্যাতন মামলাটিতে নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করা যায়।

বর্তমানে, এ আইনের জামিনের বিধানের কঠোরতা কিছুটা শিথিল করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে শর্তপূরণ সাপেক্ষে কিছু অভিযুক্তকে জামিন মঞ্জুরির এখতিয়ার ট্রাইবু্যনালকে প্রদান করা হয়েছে। যেমন, অভিযুক্ত যদি নারী, শিশু, বৃদ্ধ, রুগ্‌ন বা প্রতিবন্ধী হয় তাহলে ট্রাইবু্যনাল তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে। এছাড়া বাদীপক্ষকে শুনানির পর ট্রাইবু্যনাল যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রাথমিক বিবেচনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা নাই বা জামিন দেয়া হলে ন্যায়-বিচার বিঘ্নিত হবে না, তাহলে কারণ উলেস্নখ করে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে।

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ৬ ধারা অনুযায়ী, 'যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করিবার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।'

নারী নির্যাতনের মামলায় নারীরা বিচার পাচ্ছেন না বলে প্রচুর অভিযোগ থাকলেও, কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন এ আইনের বলি না হয় সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ, ন্যায়-বিচারের অন্যতম শর্ত হলো, একজন নিরপরাধও যেন শাস্তি না পায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<59371 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1