বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাধিকার আইন সম্পকের্ কিছু ভুল ধারণা

আমাদের দেশে উত্তরাধিকার আইন সম্পকের্ নানা ধরনের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন : অনেকেই মনে করেন, সন্তান অবাধ্য হলে তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা দিয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়, কেউবা ভাবেন মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েরা বেশি অংশ পায় আবার কেউ মনে করেন বিধবা অন্যত্র বিয়ে করলে স্বামীর উত্তরাধিকারী হবেন না। এ ধরনের ধারণার সঠিকতা যাচাই করেছেন মারুফ আল্লাম
নতুনধারা
  ৩১ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

ধারণা-১: সন্তানকে ত্যাজ্য করা যায়

কোনো সন্তান কথা মতো না চললে, আদেশ না মানলে, অবাধ্য হলে বা ঝগড়া-বিবাদ করলে বাবা-মা তাদের ত্যাজ্য করার হুমকি দেন। এমনকি সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণারও অনেক নজির আছে। সন্তানকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা সাধারণত মৌখিকভাবে দেয়া হয়। কিন্তু অনেকেই স্ট্যাম্পে লিখে বা নোটারি পাবলিক করেও সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। সেই পরিস্থিতিতে মা-বাবার মৃত্যুর পর ত্যাজ্য সন্তানের নিকটাত্মীয় ও স্থানীয় স্বাথাের্ন্বষী মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা এমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যাতে সেই ত্যাজ্য সন্তান কোনো প্রকার সম্পদ পেতে না পারে। অথার্ৎ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি মূল মালিকের কাছে না পেঁৗছে হরিলুট করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও আইন অনুযায়ী, এটা সম্পূণর্ বেআইনি, নীতি বহিভর্‚ত ও গহির্ত কাজ। সুনিদির্ষ্ট কোনো ধারা না থাকলে মুসলিম পারিবারিক আইন ও হিন্দু আইনে পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পকর্টা কোনো চুক্তি নয়। সম্পকির্ট বিবাহ, তালাক বা দাসমুক্তির মতো নয়, যে কোনো সময় ভেঙে ফেলা যায়। রক্তের সম্পকর্ কখনো মুখের কথায় পরিবতর্ন বা পরিবধর্ন হয় না। এটা স্থায়ী বিষয়।

তবে একটা বিষয় সবর্দাই গ্রহণযোগ্য। তা হলো কেউ যদি ইচ্ছে করে, তাহলে তার মোট সম্পদ থেকে এক-তৃতীয়াংশ যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তিকে দান করতে পারবে, যা মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ওই ব্যক্তিকে কেউ বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু সেটি নিজের সন্তানদের ত্যাজ্য করে নয়। তাই এই ধরনের ত্যাজ্য যদি কেউ করে, তাহলে সেই ত্যাজ্যের বিষয় ধমীর্য় বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই ধরনের নীতিমালা না ইসলামে আছে, না রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও লিপিবদ্ধ আছে।

কিন্তু ত্যাজ্যপুত্র বা কন্যা বলতে কোনো আইনি বিধান না থাকলেও মা-বাবা ইচ্ছা করলে তার সব সম্পত্তি সাফ কবলা রেজিস্ট্রি বা দান করে অন্য সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারেন। তবে সাফ কবলা বা দান লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত না হলে ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্য কন্যা বললেই বা ঘোষণা করলেই সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে না। সম্পকর্ ছিন্নও হবে না। মুসলিম আইন অনুযায়ী, কাউকে ত্যাজ্যপুত্র করা বা মৃত্যুর সময় অসিয়তের মাধ্যমে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হারাম এবং অবৈধ। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই যাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করা হয় কিংবা যাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অসিয়ত করা হয়, সে কোনোভাবেই তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না।

মুসলিম আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তিন ক্ষেত্রে তিন ধরনের ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। প্রথমত, মৃতের হত্যাকারী মৃতের সম্পত্তিতে কোনো অংশ পান না। দ্বিতীয়ত, অবৈধ সন্তান বাবার সম্পত্তিতে অংশ পান না (তবে মায়ের সম্পত্তিতে পান)। তৃতীয়ত, কোনো ব্যক্তি ধমার্ন্তরিত হলে পূবের্র ধমের্র কোনো আত্মীয়ের মৃত্যুতে উত্তরাধিকার হন না। চতুথর্ত, শত্রæরাষ্ট্রে বসবাস করলেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া যায় না।

অন্যদিকে, হিন্দু আইনেও ত্যাজ্যপুত্র করার কোনো বিধান নেই। হিন্দু আইনে ‘তাজ্য’ করে কোনো ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তির দাবি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, ত্যাজ্যপুত্র বলে কোনো বিধান আইনে নেই। তাই কেউ তার সন্তানকে ত্যাজ্য করলেও সে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্ছিত হবে না। এটা নিছক একটি ভ্রান্ত ধারণা।

ধারণা-২: মায়ের সম্পত্তি ছেলের চেয়ে মেয়ে বেশি পাবে

সুলতানা একজন চাকরিজীবী। তার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সুলতানাকে সংসারের কোনো খরচ বহন করতে হয় না বললেই চলে। এ কারণে তার আয়ের সিংহভাগই সঞ্চয়ের খাতায় জমা হয়। সুলতানা চান তার সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে কিছু স্থাবর সম্পত্তি কিনে রাখবেন। কিন্তু তিনি এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দিতে খুব দ্বিধান্বিত। কার নামে জমি কিনবেন এই নিয়ে তার দ্বিধা। তিনি ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছেন, মায়ের নামে কেনা জমিতে মেয়েরা উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে, ছেলেরা সেখানে কোনো অংশ পায় না বা পেলেও যৎসামান্য পায়। সুলতানা চান, তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তার মেয়েদের পরিবতের্ ছেলেরাই হোক। কারণ তিনি মনে করেন, মেয়েদের কাছে তার কষ্টাজির্ত সম্পত্তি চলে গেলে আদতে তার মালিক হয়ে পড়বে মেয়ে-জামাইরা। সুতরাং, তিনি তা হতে দিতে চান না।

বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের ধারণা কাজ করে। এ রকম চিন্তা থেকে নিজের নামে সম্পত্তি করতে ভয় পান অনেক নারীই। কিন্তু এই ধারণার কি কোনো ভিত্তি আছে? একেবারেই না। মুসলিম আইনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে হবেন, সে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি নারী নাকি পুরুষ সেটি মোটেই বিবেচ্য নয়। বাবা কিংবা মাÑ এদের মধ্যে যে কারও মৃত্যুতে উত্তরাধিকারসূত্রে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই সম্পত্তি পাবেন। বাবার মৃত্যুতে যে হারে ছেলেমেয়ে সম্পত্তি পেয়ে থাকেন, মায়ের মৃত্যুতেও সেই একই হারে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন ছেলেমেয়েরা। সব ক্ষেত্রেই ‘মেয়ের প্রাপ্য অংশের দ্বিগুণ’ হারে ছেলেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়ে থাকেন। সুতরাং ‘মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার বেশি, ছেলের কম’Ñ এ ধরনের ধারণা একেবারেই অমূলক।

ধারণা-৩ : বিধবা অন্যত্র বিয়ে করলে স্বামীর সম্পত্তি পাবে না

বাশার একজন প্রবাসী। প্রবাসে কমর্স্থলেই তিনি একদিন স্ট্রোক করে বসেন। পরে দীঘির্দন চিকিৎসার পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি তার স্ত্রী এবং এক ছেলেকে রেখে যান। বাশার উত্তরাধিকার ও চাকরির সূত্রে বেশকিছু সম্পত্তির মালিক। কিন্তু এই সম্পত্তি কে পাবে? তার একমাত্র ছেলে যে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে- তা নিয়ে কারও দ্বিধাই নেই; কিন্তু তার বিধবা স্ত্রীও কি এই সম্পত্তির অংশ পাবেন? এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে স্থানীয় মুরুব্বিরা মত দেন যে, বাশারের স্ত্রী যদি অবিবাহিত থেকে যান, তবেই তিনি তার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। আর যদি তিনি অন্যত্র বিয়ে করেন, তাহলে আগের স্বামী বাশারের কোনো সম্পত্তি পাবেন না।

কিন্তু মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কি এমনটি বলে? মোটেও না। মুসলিম আইনে বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রী কখনো উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন না। স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অপরের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী হবেন। এ ক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী অন্য কাউকে বিয়ে করলেন কিনা, উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে এটি মোটেও কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যত্র বিয়ে করলেও তাকে কোনোভাবেই উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কোনো স্বামী বা স্ত্রীকে যদি অন্যত্র বিয়ে করার দোহাই দিয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার অংশ আদায় করে নিতে পারবেন। এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পযর্ন্ত আদালত মৃত ব্যক্তির পুরো সম্পত্তির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পযর্ন্ত ওই সম্পত্তি কোনোভাবে হস্তান্তর কিংবা জমিতে কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, স্বামী-স্ত্রীর জীবদ্দশায় তাদের মধ্যে যদি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পাবে না। কারণ, তখন তাদের মধ্যে আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পকর্ বহাল থাকে না। এরকম ক্ষেত্রে স্ত্রী কেবল তার দেনমোহরের টাকা (যদি বাকি থাকে) দাবি করতে পারবেন। এ ছাড়া তিন মাস পযর্ন্ত খোরপোষ পাবেন স্ত্রী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<5749 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1