মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পিতা-মাতার যত আইনগত অধিকার

সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনকারী পিতা-মাতা যেন সন্তান কর্তৃক অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সে জন্য রয়েছে আইন। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও থাকলেও পিতা-মাতাকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। সব পিতা-মাতাই সন্তানের মঙ্গল চান। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে কোনো সন্তান যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণে পিতা-মাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তারা আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

সন্তানের সম্পত্তিতে পিতা-মাতার অধিকার :

বাবা তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। (ক) যদি মৃত সন্তানের পুত্র, পুত্রের পুত্র বা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যতই নিচে হোক না কেন কোনো পুত্রের অস্তিত্ব থাকে, তবে মৃত সন্তানের পিতা পাবেন তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ। (খ) যদি মৃত সন্তানের কেবল কন্যাসন্তান বা তার পুত্রের কন্যাসন্তান থাকলে তবে পিতা তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন। এই ক্ষেত্রে কন্যাদের ও অন্যদের দেয়ার পর অবশিষ্ট যে সম্পত্তি থাকবে তাও পিতা পাবেন। (গ) আর যদি মৃত সন্তানের কোনো পুত্র-কন্যা বা পুত্রের সন্তান কিছুই না থাকে তবে বাকি অংশীদারদের তাদের অংশ অনুযায়ী অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট যা থাকবে তার সবটুকুই বাবা পাবেন।

মাতাও তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে অংশ পেয়ে থাকেন। (ক) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি (যত নিচেই হোক) থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই-বোন থাকলে তবে মা ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন। (খ) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে এবং যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) পাবেন। (গ) কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুজন ভাই-বোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) মাতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।

সন্তানের কাছে বিধবা মায়ের অধিকার :

একজন বিধবা নারীকে তার স্বামীর মৃতু্যর পর কোনোভাবেই তার বাসস্থান থেকে জোর করে বের করে দেয়া যাবে না। স্বামীগৃহ, যেখানে তিনি বসবাস করছেন, এ গৃহে তার বাস করার অধিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার প্রাপ্য সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তবে তিনি স্বেচ্ছায় অন্য কোথাও থাকতে চাইলে তাকে বাঁধা দেয়া যাবে না। তিনি অন্যত্র বিয়ে না করলে তার সন্তানদের তত্ত্বাবধান করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। একজন বিধবা স্ত্রী স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির সন্তান থাকা অবস্থায় ১/৮ এবং সন্তান না থাকলে ১/৪ অংশ পাবেন।

একজন নারী তার স্বামীর মৃতু্যর পর ইদ্দতকালীন (চার মাস ১০ দিন) সময় পার করার পর নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য সাধারণ নারীর মতো স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তিনি অন্যত্র বিয়ে করবেন কি করবেন না, এটা তার সম্পূর্ণ স্বাধীন সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

সন্তানের কাছে মায়ের দেনমোহর ও ভরণপোষণের অধিকার :

একজন বিধবা তার স্বামীর পরিশোধ করে না যাওয়া দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। স্বামীর মৃতু্য হলেই যে দেনমোহর পাবেন না, তা নয়। দেনমোহর ঋণের মতো, স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর উত্তরাধিকারীরা তা পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর পরিশোধ না করা হলে স্বামীর মৃতু্যর তিন বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করে তিনি তা আদায় করতে পারবেন। এ ছাড়া স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অংশ একজন বিধবা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবেন কিংবা দখলে রাখার অধিকার রয়েছে বলে বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ (১৮৭১) ১৪ এম আই এ পৃষ্ঠা ৩৭৭-এ উলেস্নখ রয়েছে। একজন বিধবা মা তার সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পেতে হকদার। সন্তানরা ভরণপোষণ না দিলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। (জমিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, ৪৮ ডিএলআর (আপিল বিভাগ), পৃষ্ঠা ১১০।

দেনমোহরের দাবিতে কোনো বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে অন্যায়ভাবে সেই সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব (১৯১৬) ৪০ বনাম. পৃষ্ঠা-৩৪)

বিধবা মা অন্যত্র বিয়ে করলেও আগের স্বামীর সম্পত্তি পাবেন :

স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অন্যের মৃতু্যতে সবসময়ই উত্তরাধিকারী হবেন। এ ক্ষেত্রে স্বামীর মৃতু্যর পর স্ত্রী বা স্ত্রীর মৃতু্যর পর স্বামী অন্য কাউকে বিয়ে করলেন কিনা, উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে এটি মোটেও কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যত্র বিয়ে করলেও তাকে কোনোভাবেই স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

অন্যত্র বিয়ে করার দোহাই দিয়ে কোনো স্বামী বা স্ত্রীকে যদি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার অংশ আদায় করে নিতে পারবেন। এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আদালত মৃত ব্যক্তির পুরো সম্পত্তির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সম্পত্তি কোনোভাবে হস্তান্তর কিংবা জমিতে কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না।

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন :

পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩, কতগুলো বাধ্য-বাধকতার নির্দেশ দিয়েছে। একাধিক সন্তান থাকলে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে এবং তাদের একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করবে। পিতা বা মাতা অথবা তাদের উভয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা যাবে না। প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। যে ক্ষেত্রে পিতা বা মাতা জীবিত নেই সে ক্ষেত্রে দাদা-দাদি অথবা নানা-নানি জীবিত থাকলে এই আইন অনুযায়ী তাদেরও ভরণপোষণ দিতে হবে।

পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করার দন্ড :

কোনো সন্তান এ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং ওই অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে; বা ওই অর্থদন্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। এমনকি কোনো পুত্রবধূ বা মেয়ের জামাই অথবা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি পিতা-মাতার বা দাদা-দাদির বা নানা-নানির ভরণপোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করেন বা ভরণপোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করেন তাহলে তিনি ওইরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তিনিও দন্ডে দন্ডিত হবেন।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী,

আইনগ্রন্থ প্রণেতা ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<44617 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1