শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭

ত্রিশ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি

১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, উচ্চ আদালতের ২০১৪ সালের রায় এবং জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সরকারের সময়ের এক ডজনেরও বেশি আদেশ, পরিপত্র বা বিধি থাকলেও সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি...
আদনান ওয়াসিম
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে প্রণয়ন করা হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। ১৯৮৭ সালের ২নং আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি পূর্ণরূপে কার্যকর করার এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়ের জন্য বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় বিধায় এই আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি কার্যকারিতা দেয়া হয়েছে তখন থেকেই।

মাত্র চারটি ধারা নিয়ে গঠিত ছোট এই আইনের সারকথাগুলো স্থান পেয়েছে ৩নং ধারায়। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। আর এসব ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলয়া গণ্য হবে। সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করলে তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে- এমন বিধানও রাখা হয়েছে।

বাংলা ভাষা প্রচলন আইন না মানলে অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এমন বিধান থাকলেও ১৯৮৭ সালের পর থেকে কারও বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই। এই আইন ছাড়াও সব সরকারের সময় আদেশ-নির্দেশের মাধ্যমে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজের কাজ হয়নি।

আইনটি কেবল সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় বেসরকারি কাজকর্মে এ-সংক্রান্ত আইনি বাধ্যবাধকতাও নেই। যদিও উচ্চ আদালতের রায়ে সরকারি, বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আইনটির ৪নং ধারায় সরকারকে সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও সেই বিধি এখনো পর্যন্ত প্রণীত হয়নি।

বিভিন্ন উদ্যোগের পরও সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র্রভাষায় ব্যবহার নিশ্চিত হয় নাই : সরকারের বড় উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূল সংবিধান, ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, উচ্চ আদালতের ২০১৪ সালের রায় এবং জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সরকারের সময়ের এক ডজনেরও বেশি আদেশ, পরিপত্র বা বিধি থাকলেও সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি।

১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো) প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোষের কার্যক্রমও চলছে ঢিমে তালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাবাকো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৪টি আইন, বিধি ও অধ্যাদেশ প্রমিতিকরণ করেছে। এ ছাড়া অন্য সব মন্ত্রণালয়ের ৫৭টি আইন বা অধ্যাদেশ প্রমিতিকরণ করেছে। অথচ শত শত আইন এখনো ইংরেজিতে রয়েছে, যেগুলোর অনুবাদের পর বাবাকোর প্রমিতিকরণ করার কথা। এ পর্যন্ত বাবাকোর উলেস্নখযোগ্য অর্জন হচ্ছে, প্রশাসনিক পরিভাষা, পদবি পরিভাষা ও সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা এই তিনটি পুস্তিকা প্রণয়ন করা। সচিবালয় নির্দেশিকা ২০১৪ প্রণয়নে বাবাকো সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছে।

কোষের মোট জনবল ছিল ২৩ জন, এটা কমিয়ে ১২ জন করা হয়েছে।

বাংলার ব্যবহার নিয়ে নানা উদ্যোগ:

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।' ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, বাংলা হবে দেশের সরকারি ভাষা।

বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। ওই বছরের ১২ এপ্রিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, 'সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, ভবিষ্যতে সব নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি ইত্যাদি অবশ্যই বাংলায় প্রণয়ন করিতে হইবে।' ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা নিশ্চিত করতে মন্ত্রিসভা নয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বছরের ১৬ ফেব্রম্নয়ারি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১০ সচিবের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েক মাস পর ৩ মে বঙ্গভবনের আদেশে বলা হয়, সব নোট, সার-সংক্ষেপ বা প্রস্তাবটি বাংলায় উপস্থাপনা করা না হলে রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করবেন না। ৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত আদেশটি সবাইকে অবহিত করে।

বিচারপতি কাজী ইবাদুল হক এবং বিচারপতি মো. হামিদুল হক সমন্বয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রম্নয়ারি ফৌজদারি মামলায় বাংলায় রায় দেয়ার পর তা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে রায় দেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপেস্নট, বিভিন্ন দপ্তরের নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। যা এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<37306 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1