বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামীকে তালাক বনাম শিশুসন্তানটির ভবিষ্যৎ

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

একটি অভিজাত পরিবারের শিক্ষিতা মেয়ে রুশি (ছদ্মনাম)। হঠাৎ একদিন আইনজীবী চেম্বারে এসে হাজির। পরিচয় পবের্ই মেয়েটিকে অদ্ভুত প্রকৃতির মনে হলো। তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় নিয়ে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ছাড়ল। একটা মানুষ অজানা বিষয় জানতে চাইতে পারে। আমি ধৈযর্ ও আন্তরিকতা নিয়েই তার প্রশ্নগুলো শুনে, বুঝে উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম।

মেয়েটি প্রথমে আমার কাছে জানতে চাইল, ধরুন কেউ যদি শুধু কোটর্ ম্যারেজ করে, কিন্তু কাবিননামাটি সম্পন্ন না করে সংসার করতে থাকে, তাহলে বিয়ের বৈধতা কতটুকু? আমি তাকে জানালাম, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কোটর্ ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই। অনেকে ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কাযার্লয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী কাবিন রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে। মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ বিধি ২০০৯-এর ৫(২) বিধি অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি যদি বিবাহ করান তাহলে বর ৩০ দিনের মধ্যে ওই নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে অবহিত করবেন, যার এলাকায় ওই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৪-এর ধারা ৫(৪) অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করার শাস্তি সবোর্চ্চ দুই বছর পযর্ন্ত বিনাশ্রম কারাদÐ বা তিন হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দÐে দÐিত করার বিধান রয়েছে।

বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নিধাির্রত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়েসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সম্বন্ধে আইনগত দলিল যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। লাইসেন্সবিহীন কাজীর কাছে বিয়ে রেজিস্ট্রি করলে এর কোনো আইনগত মূল্য নেই। কাজীর কাছে গিয়ে কাবিন না করলে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাবিননামা না থাকায় নারীরা তাদের মোহরানাও পায় না। আইনানুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যায়। এ ছাড়া কাবিননামার সব কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্য ব্যক্তিদের স্বাক্ষর দিতে হয়।

উপরের গল্প ও প্রশ্নোত্তর শুনে মেয়েটি বলল, আমি আমার স্বামীকে ভালোবেসে কোটর্ ম্যারেজ করেছিলাম। আমাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। কিন্ত আমি তাকে তালাক দিতে চাই। আমি মেয়েটিকে জানালাম, কাবিননামা ছাড়া তালাকের রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। কাযর্কর করা যায় না। এক অথের্ আপনার বিয়েটার আইনগত ভিত্তি নেই। তবু একত্রে যেহেতু সংসার করেছেন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে, ধরে নেয়া যেতে পারে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী বিয়েটা হয়েছে। যেহেতু আপনি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে কোটর্ ম্যারেজ করেছেন, সেহেতু আপনি নোটারি পাবলিকের মতো হলফনামার মাধ্যমে তাকে তালাক দিতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যাটি এমন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পকর্ যদি এমনপযাের্য় পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোনো এক পক্ষের সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে তারা নিদির্ষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অন্যকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশিগগিরই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং যাকে তালাক দেয়া হচ্ছে ওই নোটিশের নকল তাকে প্রদান করতে হবে। চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পযর্ন্ত বলবৎ হবে না। নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশি পরিষদ গঠন করবে এবং ওই সালিশি পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনমির্লনের) জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গভর্বতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত¡া থাকলে উল্লিখিত সময় অথবা গভার্বস্থা-এ দুটির মধ্যে দীঘর্তরটি অতিবাহিত না হওয়া পযর্ন্ত তালাক বলবৎ হবে না।

১৯৩৯ সালের মুুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইনে অত্যন্তÍ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে। কারণগুলো হলোÑ চার বছর পযর্ন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে, দুই বছর স্বামী-স্ত্রীর খোরপোশ দিতে ব্যথর্ হলে, স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি কারাদÐ হলে, স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যথর্ হলে, বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পযর্ন্ত বজায় থাকলে, স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে, বিবাহ অস্বীকার করলে, কোনো মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পকর্ (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোনো বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে, স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে এবং স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।

উপরের যে কোনো এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেয়ার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশকে তালাকসংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সেদিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চ‚ড়ান্তভাবে কাযর্কর হবে।

তালাক বিষয়ে আইনগত ব্যাখ্যার পর মেয়েটির এবারের প্রশ্ন, আমার মেয়েটি আমার সাথে থাকতে পারবে কিনা? এ প্রশ্নেরও উত্তর দিলাম।

গল্পের মেয়েটি তার আট বছরের সংসার জীবনের ইতি টানলেন স্বামীকে পুরুষত্বহীন আখ্যা দিয়ে। এরপর বেশকিছু দিন পরে এলেন আমার চেম্বারে। পরিচয় করিয়ে দিলেন অন্য এক ছেলের সঙ্গে। বললেন, আমার সব কথা জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি ওর মধ্যে আমার না-পাওয়া অতীতগুলো খুঁজে পেয়েছি। আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন। একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজীকে ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কী অদ্ভুত মানুষের জীবন-যৌবন-সম্পকর্। কী অদ্ভুত মানুষের চেতনা-চৈতন্য।

শিশুসন্তানটির মাবিহীন আগামী জীবন কেমন হবে অথবা পুরুষত্বহীন স্বামী কীভাবে সন্তানটি জন্ম দিলÑ এসব প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া গেল না।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26453 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1