শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে ‘পরকীয়া’ মামলা ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পকর্ করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পঁাচ বছর পযর্ন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে ‘অপরাধের শিকার’ বিবেচনা করে আইনে সম্পকর্ স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোটের্ মামলা দায়ের করেন যোশেফ শাইন...
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়। ইংরেজ শাসনকালে তৈরি দÐবিধির ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক। এমনটিই রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোটর্। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে পঁাচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পযের্বক্ষণ, এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খবর্ করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। ব্রিটিশদের তৈরি করা ১৮৬০ সালের আইনকে চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলার প্রেক্ষিতেই শীষর্ আদালত এই রায় দিয়েছে। রায়ের পর থেকেই সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকমীর্, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ধমীর্য় নেতা ও সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তকর্-বিতকর্ এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশন টক শো ও পত্রিকার কলাম পযর্ন্ত। সন্দেহ নেই আরও কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।

১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পকর্ করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পঁাচ বছর পযর্ন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে ‘অপরাধের শিকার’ বিবেচনা করে আইনে সম্পকর্ স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোটের্ মামলা দায়ের করেন যোশেফ শাইন। পরকীয়া অপরাধ নয় জানিয়ে এ সংক্রান্ত দেড়শ বছরের পুরনো একটি আইন বাতিল করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোটর্। তবে শীষর্ আদালত বলেছেন, পরকীয়া সম্পকের্র কারণে জীবনসঙ্গী যদি আত্মহত্যা করেন এবং আদালতে যদি তার প্রমাণ দাখিল করা যায় তবেই এটি অপরাধে প্ররোচনা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে সরকারি কৌঁসুলিরা ‘বিয়ের পবিত্রতা’ রক্ষার স্বাথের্ আইনটি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের একটি ঘটনা দেখা যাক। সুজন ও রিতার (ছদ্মনাম) দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোন তাদের সুখের সংসারকে তছনছ করে দেয়। সুজনের এক বন্ধু তাকে ফোন করে জানান যে তার স্ত্রী রিতা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বসুন্ধরা সিটিতে ঘোরাফেরা করছে। ব্যবসায়ী সুজন বসুন্ধরা সিটিতে তখনই গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছেলেটির পরিচয় জানতে চান। এ সময় সুজনের স্ত্রী উল্টো তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না।’ সুজন রাগ সংবরণ করতে না পেরে স্ত্রীকে তখন কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। নারীর গায়ে হাত তোলার অপরাধে উপস্থিত নিরাপত্তা রক্ষীরা সুজনকে পাকড়াও করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে পুলিশের জেরায় সব সত্য প্রকাশ করেন রিতা। এসময় রিতার প্রেমিক পুলিশকে বলেন, ‘রিতার সঙ্গে আমার এক বছরের সম্পকর্। অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে আমার কাছে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ এসময় স্বামীকে না চেনার ভান করায় সুজনও রিতাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করেন। ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়! শেষমেশ রিতা সুজনের কাছে ক্ষমা চায় এবং প্রেমিক ওই পুরুষটি তাকে ভুল বুঝিয়ে এ পথে নামিয়েছে জানিয়ে তার বিচার দাবি করেন। সুজন শেষমেশ রিতার কথামতো ওই প্রেমিক পুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন।

বাংলাদেশে দÐবিধির ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী জানা সত্তে¡ও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরূপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধষের্ণর অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদÐে অথবা অথর্দÐে অথবা উভয় দÐে দÐিত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নিযাির্ততাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কমের্র সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোনো সাজা পাবে না। এ বিষয়ে মহামান্য লাহোর হাইকোটর্ একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪ সন্নিবেশিত রয়েছে। মহিলা আসামি হতে পারে না। তবে ওই পুরুষটির সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ওই মহিলার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার সময় আসামি জানত অথবা জানার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল যে, যৌন সঙ্গমকারী মহিলা অন্য কোনো ব্যক্তির স্ত্রী। উল্লেখ থাকে যে, কোনো মহিলাকে তার আগের স্বামী তালাক দিয়েছেন এই সরল বিশ্বাসে আসামি বিবাহ করলে তাকে এ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে মহিলার সঙ্গে সঙ্গম করা হয় সে মহিলা ওই সময় বিবাহিত না হলে এই ধারার অধীনে কোনো অপরাধ আমলে আনা যায় না। এ ধারা অধীন শাস্তি দিতে হলে বিবাহের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়।

তবে মহামান্য লাহোর হাইকোটর্ বলেছেন, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীঘির্দন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না যে, তারা ব্যভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।

যেহেতু এ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য, অভিযুক্ত প্রেমিক পুরুষ আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমপর্ণপূবর্ক জামিনের আবেদন জানান এবং বিচারক মহোদয় তাকে জামিন দেন। এ মামলায় আসামিকে সাজা দিতে হলে বাদীকে পঁাচটি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। প্রথমত আসামি কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেছিল, দ্বিতীয়ত ওই নারী বিবাহিত ছিল, তৃতীয়ত আসামি বিবাহের বিষয়টি জানত এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল, চতুথর্ত ওই যৌন সঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমথর্ন ব্যতিরেকে হয়েছিল, পঞ্চমত : ওই যৌন সঙ্গম নারী ধষের্ণর সামিল ছিল না।

যেহেতু সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারামতে কোনো ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর। গোপাল চন্দ্র বনাম লাসমত দাসী মামলা যা ৩৪ ডিএলআর, ১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, বিচাযর্ বিষয় সম্পকের্ যে পক্ষ কোনো ঘটনার অস্তিত্বের দাবি করে সে পক্ষই তা প্রমাণ করবে।

এ মামলায় আসামি যে রিতার সঙ্গে ব্যভিচারী করেছে, বাদী সুজন প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় বিচারিক প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পঁাচ বছরের বিনাশ্রম কারাদÐ, সেই সঙ্গে অথর্ দÐেও দÐিত করে রায় প্রদান করেন।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<15242 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1