শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যেসব কারণে গুরুত্ব হারায় নারী নিযার্তন মামলা

আবরার মাসুদ
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

দৃশ্যপট-১ : দীঘির্দনের প্রেম শেষে মেহেদী ও অদিতি সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার। বছর দুয়েক ভালোই চলছিল নবদম্পতির সংসার। এ সময় অদিতির কোলজুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান। হঠাৎ ঠুনকো এক বিষয় নিয়ে শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। অবস্থা এমন দঁাড়ায় যে, অদিতি তার স্বামী মেহেদীকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে উঠতে বাধ্য হয়। রাগে-ক্ষোভে অদিতিকে নিয়ে তার বাবা যান আদালতে। আইনজীবীর পরামশের্ অদিতিকে ভতির্ করা হয় স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। একদিন পর ‘শারীরিক নিগ্রহ’ সনদ নেয়া হয়। কাজী অফিস থেকে কাবিননামার কপি সংগ্রহ করে আবার তিনি যান আইনজীবীর কাছে। এরপর দেয়া হয় নারী নিযার্তন মামলা। অদিতি বাদী হয়ে স্বামী, বৃদ্ধ শ্বশুর ও শাশুড়িকে আসামি করে ‘নারী ও শিশু নিযার্তন দমন ট্রাইব্যুনালে’ নালিশি মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ বিচারক অদিতির জবানবন্দি শুনে মামলাটি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচাজের্ক নালিশকে এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা রুজু করার নিদের্শ দেন। ওসি মামলাটি এজাহার হিসেবে রুজু করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করেন। চাজির্শট দাখিলের আগ পযর্ন্ত স্বামী মেহেদী ও তার বৃদ্ধ মা-বাবা ওই মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। প্রথমত, জামিন-অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত, এ মামলায় সাধারণত নি¤œ আদালত জামিন প্রদান করে না। মামলা থেকে বঁাচতে আসামিরা বাদী অদিতির সঙ্গে আপসের চেষ্টা চালায়। অদিতিও নিজ সন্তান ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপসে রাজি হন। কিন্তু এরই মধ্যে স্বামী মেহেদী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। অদিতি ছুটে যায় থানায়। ওসি ও তদন্তকারী কমর্কতাের্ক আপসের কথা খুলে বলেন এবং তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন।

ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বাদী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান আদালতে। মেহেদীর আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন, বাদী অদিতি ও তার আইনজীবী আদালতে দঁাড়িয়ে আসামির সঙ্গে আপস-মীমাংসা হয়ে সুখে দাম্পত্য কাটানোর কথা বলে আসামির জামিনে অনাপত্তির আবেদন জানায়। ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। মেহেদীর জায়গা হয় জেলহাজতে। নি¤œ আদালতের নথি তলব, জামিন শুনানির পরবতীর্ তারিখ নিধার্রণ শেষে প্রায় দেড় মাস পর মেহেদী জামিনে মুক্তি পায়।

দৃশ্যপট-২ : রাজধানীর আদাবরে ১৩ বছরের মিশুকে উত্ত্যক্ত করত এলাকার দুই যুবক। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি পাড়ার ওষুধের দোকানে অপেক্ষারত দুই যুবক মেয়েটির হাত ধরে টানাহেঁচড়া করে, চড়-থাপ্পড় মারে। রাগে ক্ষোভে ও অপমানে ঘরে ফিরে মিশু আত্মহত্যা করে। মারা যাওয়ার আগে আত্মহত্যার কারণ চিরকুটে লিখে যায়। অভিযুক্ত দুজন গ্রেপ্তার হয়ে বছর না ঘুরতেই জামিনে বেরিয়ে আসেন। গত সাড়ে সাত বছর ধরে এ ঘটনার আদালতে বিচার চলছে। এ পযর্ন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন আত্মীয়।

ঢাকা জেলার একাধিক ট্রাইব্যুনালে আসা ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারিক নিবন্ধন থেকে ধষর্ণ, গণধষর্ণ, ধষের্ণর পর হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌনপীড়নের মতো গুরুতর অপরাধে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পযর্ন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য থেকে দেখা যায়, তখন পযর্ন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১১০টি মামলায়। অথার্ৎ সাজা হয়েছিল ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস হয়ে গেছে। মামলাগুলো বেশির ভাগ থানায় করা। কয়েকশ মামলা হয়েছে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে। সবকটিরই তদন্তের ভার পুলিশের। তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি ও অদক্ষতাও দেখা গেছে। আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযতœ ও গাফিলতি থাকে। অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। কখনো আদালতের বাইরে আপস হয়। অভিযোগকারীদের বড় একটি অংশ দরিদ্র। এসব অভিযোগকারীরা স্বল্প আয়ের পোশাককমীর্, গৃহকমীর্, বস্তিবাসী বা ছিন্নমূল নারী ও শিশু। তারা থানা আর আদালতে ঘুরে ঘুরে খরচপত্র করে একটা সময় গিয়ে আর মামলা টানতে পারেন না।

নারী নিযার্তনের মামলায় নিযাির্তত নারীর দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করা। আর যে মামলায় সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকবে সেই মামলা খারিজ হয়ে যাবে এবং আসামিও খালাস পেয়ে যাবে। কাজেই এই জাতীয় মামলায় বাদীকে অবশ্যই সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে হবে। দ্বিতীয়ত মামলার আইনজীবীকে নিদির্ষ্ট তারিখ বা কমির্দবস সম্পকের্ সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, বাদীপক্ষের আইনজীবী মামলার শুনানির তারিখে অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। একইভাবে কখনো কখনো বাদীপক্ষের সাক্ষী নিদির্ষ্ট তারিখে হাজির হতে পারে না। ফলে মামলা দীঘের্ময়াদি হয় এবং বাদীপক্ষ আগ্রহ বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কাজেই মামলার আইনজীবী, বাদী ও সাক্ষী নিয়মিত থাকলে মামলা নিধাির্রত সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এতে বাদীপক্ষ যেমন আগ্রহ হারাবে না একইভাবে আসামিরও খালাস পাওয়ারও সুযোগ থাকে না।

প্রাথমিকভাবে নারী নিযার্তনের মামলা গুরুতর হলেও পরবতীর্ কিছু দিন পরে আসামি কোনো না কোনোভাবে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর নিযাির্ততাকে ভয় দেখানো, মামলা তুলে নেয়ার চাপ দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকে। এই ধরনের মামলায় আসামির জামিন পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে একটা নিদির্ষ্ট সময় শেষে আসামি কোনো না কোনোভাবে জামিন পেয়ে যায়। প্রথমত অধিকাংশ বাদীই মামলা করার কিছুদিন পর মামলার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যার জন্য মামলার ধীরগতিই দায়ী। তাই এই জাতীয় মামলা নিদির্ষ্ট কাযির্দবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশের চাজির্শট প্রদানসহ যাবতীয় কাযর্ক্রম নিধাির্রত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া মামলার নিয়মিত নজরদারি ও একই সঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ, ডাক্তার, ভিকটিম, সাক্ষী, আইনজীবী ও বিচারক সবাইকেই আন্তরিক ও ইতিবাচক হবে। সরকারকেও আন্তরিক হতে হবে।

নারী ও শিশু আইনের অধিকাংশই মিথ্যা মামলা বলে বিচারিক কমর্কতার্রা মনে করেন। কাজেই মামলা মিথ্যা হলে সেটা প্রমাণ হয় না। এই জাতীয় মামলার বেশির ভাগই সঠিক তদন্ত ও সঠিকভাবে পরিচালনার অভাব রয়েছে। কাজেই যে কোনো মামলার সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে বা তদন্তের গাফিলতি থাকায় সে মামলা সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। এ ছাড়া মামলা পরিচালনা করেন যে পাবলিক প্রসিকিউটর তাদের অধিকাংশেরই অদক্ষতা এর সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে কিছু কিছু বিচারকের কারণে নারী ও শিশু নিযার্তন মামলায় ৯৫% আসামি খালাস পেয়ে যায়।

এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে নিযাির্তত অধিকাংশ নারীই যে ভুলটি করে সেটা হচ্ছে তারা মামলার এজাহারে শুধু যৌতুকের জন্য স্বামী মারধর করেছে কথাটি লিখে। একই সঙ্গে তাকে তালাকও দিতে চায় এ কথাটি না লিখে শুরুতেই মামলাটি হালকা করে ফেলে। অথচ প্রাথমিকভাবে তালাকের কথা উল্লেখ করলে আসামির খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এ ছাড়া সরাসরি আদালতে পিটিশন মামলার ক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশনে যদি না আসে যে বাদিনী থানায় মামলা করতে গেলে স্থানীয় থানা মামলা না নেয়ায় বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেছে তাহলে আসামি খুব সহজেই খালাস পেতে পারে। অথার্ৎ অধিকাংশ ঘটনাই সত্য হওয়ার পরেও আইনের মারপ্যঁাচে বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে আইনজীবীরা যদি মামলাটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে এবং বিচারকরা একটু কেয়ারফুল হলে আসামিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<12935 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1