শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাকলী

মো. মাঈন উদ্দিন
  ০৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

কাকলী। সাজলে অপূর্ব সুন্দরী দেখায় তাকে। সাক্ষাৎ দেবীর অবতার। এই অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি কী করে বড় হয়ে গেল- মা বাবা টেরই পায়নি। এপাড়া ওপাড়ার বখাটে ছেলেরা যখন বাড়িতে উঁকি-ঝুঁকি দিতে শুরু করে, তখন বাবা-মায়ের খেয়াল হয়- মেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরী মেয়েরা একটু তাড়াতাড়ি-ই বড় হয়। অল্পতেই মেয়ে অনন্য যৌবনা হয়ে উঠেছে। ষোলোতেই বিয়ে হয়ে যায় কাকলীর। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। অনেক টাকা উপার্জন। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। শহরে নিজস্ব বাসা আছে। বিয়ের পর স্বামী সংসারে চাঁদ হয়ে আসে কাকলী। বিভোর সুখে বসবাস। রূপবতী স্ত্রীকে না দেখে থাকতেই পারে না স্বামী রূপাই চক্রবর্তী। একদিন-দু'দিন-তিনদিন পর তার দম বন্ধ হয়ে যায় যেন। কাকলীর এক ফোন কলে একশ' কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসে রূপাই। স্ত্রীর ম-ম চুলের গন্ধে নিশ্বাস ফিরে পায়। হাতের ছোঁয়ায় ফিরে পায় প্রাণ প্রদ্বীপের সজীবতা। স্বামীর কপালে গোলাপী ঠোঁটের চুম্বন এঁকে কাকলী বলে, 'তোমাকে ছাড়া আমি থাকতেই পারি না। একা লাগে। ভীষণ একা।' রূপাই ফিসফিস করে বলে, 'আমারও'। স্বামীর ভালোবাসায়। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ভাসুরের আত্মী যত্নে অতি সুখে কাটে কাকলীর দিনগুলো। কিছুদিন পর পুরো ঘর আলোকিত করে আসে এক পুত্র সন্তান। খুশিতে চিকচিক করে রূপাই চক্রবর্তীর উৎসুখ চোখ দু'টি। আর মাতৃত্বের গর্বে ভরে যায় কাকলীর মন। পুত্র সন্তানের চোখে হাজার বছরের স্বপ্নের বীজ রোপণ করে কাকলী-রূপাই দম্পতি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাদের সুখের স্বপ্নে চিড় ধরে। পুত্র সন্তানের অস্বাভাবিকতা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। 'আপনাদের সন্তান প্রতিবন্ধী। সে হয়তো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবে না। পারবে না স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে।' ডাক্তারের কথায় চকচকে রোদের আলো ফিকে হয়ে আসে। বেদনায় কুঁকড়ে উঠে তাদের মন। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলায় কাকলী। একমাত্র পুত্র সন্তানের অস্বাভাবিকতা তাকে কাঁদায় প্রতিনিয়ত। সন্তানের মুখপ্রাণে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে- বিধাতা, দিলেই যদি তবে কেন অপূর্ণতা। রূপাই সান্ত্বনা দেয়, 'কেঁদো না। সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভরসা রাখ। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। পুণ্যের জন্যই করেন।' সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের ওপর সুখের প্রলেপ পড়ে। ঢিল ছুড়া পানির তরঙ্গ শূন্যে মিলিয়ে যায়। পৃথিবীতে আগমন ঘটে দ্বিতীয় সন্তানের। ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের। নাহ, এবার আর অপূর্ণ নয়। ধীরে ধীরে কন্যা সন্তানের স্বাভাবিকতা ফুটে উঠে। ঠিক যেন মায়ের মতো এক রূপবতী কন্যা। এক সাদা পরী। হাস্যজ্জ্বল। চঞ্চলা। সন্তানের দূরন্তপনায় বাবা-মায়ের মন ভরে উঠে। গর্বে। আনন্দে। রূপাইয়ের আয় বাড়তে থাকে তরতর করে। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরিতে হাত দেয় রূপাই। পাঁচতলা বিল্ডিং। দ্বিতীয় তলার পুরো ফ্লোরে থাকে কাকলী পরিবার। আর বাকি ফ্ল্যাট ভাড়া।

কাকলী অসহায় হয়ে পড়ে। অনেক থেকেও যেন কিছুই নেই তার। যে একাকিত্বকে সে সহ্য করতে পারত না, সেই একাকিত্বই তাকে ঝাপটে ধরেছে এখন। মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে বিধবার তকমা গ্রহণ করতে হয়। এ যেন একা থাকার অলিখিত বাধ্যবাধকতা। বয়সের হিসেবে ঊনত্রিশ হলেও রূপ দর্শনে এখনো উনিশ। কাকলী গ্রিল ধরে তাকিয়ে থাকে বাহিরে। উদাস নয়নে। নির্বাক কণ্ঠে। গোলাপ, হাসনাহেনার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় কাকলী অথচ তার সৌন্দর্য দেখার কেউ নেই। কাঁঠালগাছে চড়ুই পাখি ওড়াউড়ি করছে। এ-ডালে ও-ডালে। একটি নয়। দুটি চড়ুুই। অন্য ডালে দুটি শালিক। কিচিরমিচির করে কী যেন বলছে। কাকলী ভাবে, 'প্রতিটি পাখিও জোড়ায় জোড়ায় থাকতে ভালোবাসে অথচ আমি একা হয়ে গেলাম। সম্পূর্ণ একা। হয়তো বা বাকিটা জীবন আমাকে একাই থাকতে হবে! বাকিটা জীবন! এটাই বাস্তবতা। নিষ্ঠুর বাস্তবতা।'

রূপাইয়ের মৃতু্যর তিন-চার মাসের মধ্যে কাকলীর দেবর নিহাল দেশে আসে। জর্ডান থেকে। সেখানে বিয়েও করেছিল নিহাল। কিন্তুু বউয়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্স হয়ে গেছে। নিহাল কাকলীর ছেলে মেয়ে দু'টোর সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায়। কাকলীর সন্তানরাও কাকাবাবুর সান্নিধ্য পেয়ে বেজায় খুশি। কাকলীর মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠে। 'সন্তানগুলো বাবার সোহাগ থেকে বঞ্চিত। কাকাবাবুর আদর পাচ্ছে- মন্দ কী।' একদিন দুপুরের খাবার শেষে কাকলী বলে, 'নিহাল, তুমি আমার সন্তানদের বাবার কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছো। তোমাকে ধন্যবাদ।' নিহাল তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে আর কাকলীর পানে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। বলে, 'বউদি, তোমার অনেক কষ্ট জানি। আপত্তি না থাকলে তোমার কষ্টের ভাগ নিতে চাই আমি।' চমকে উঠে কাকলী। ধমকা বাতাস ছুঁয়ে দেয় তার দেহ, তার মন। কিছু বলে না। নিঃশব্দে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

স্নানের সময়। কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে কাকলী। মাথার চুল খোলে আয়নার দিকে তাকায়। আয়নার পেছনে আরেক কাকলী। কাকলীর প্রতিচ্ছবি। কাকলী তাকায় আয়নার ওপাড়ে। অঙ্গ-প্রতঙ্গের দিকে। সবার সাক্ষাৎকার নিতে চায় সে। 'নিহালের প্রস্তাবে কি রাজি তোরা? তাদের নীরব উত্তর পেয়ে যায় কাকলী। কেউ বা বলে- বিয়ে করে ফেল। একাকী জীবন নিয়ে কতদিন চলবে? একাকিত্ব ঘুচাও। কেউ বলে- বিয়ে করলে সমাজে তুমি ছোট হয়ে যাবে। চালিয়ে যাও। তোমার অন্দর মহলে চলুক কীর্তন খেলা। আনন্দ গান। কেউ জানবে না। কেউ দেখবে না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে কাকলী। রহস্যময় হাসি। এ হাসির রহস্য হয়তো কেউ জানে না। জানে শুধু কাকলী। আর ওই সৃষ্টিকর্তা, যিনি হাসছেন পর্দার আড়াল থেকে।

সদস্য

জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

\হময়মনসিংহ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90899 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1