শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদান

মো. মাঈন উদ্দিন
  ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

প্রতিবছর নভেম্বর মাসের এক তারিখে রাস্তার ঠিক এ জায়গাটায় ফুল দেয় সাবু দাদা। আজও তিনি ক্র্যাচে ভর করে হাত ভর্তি ফুল নিয়ে এসেছেন। ফুল দেয়ার পর দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা জল। দূর হতে বিষয়টি লক্ষ্য করে আসিফ। গতবছর ফুল দেয়ার পর চুপিচুপি চোখের জল মুছছিল সাবু দাদা। আসিফের চোখে ধরা পড়েছিল সেবারও। সাবু দাদা আর আসিফ পাশাপাশি বাসায় বাস করে। ইন্টার পড়ুয়া আসিফকে সাবু দাদা খুব পছন্দ করে। বিকেল বেলা যখন সাবু দাদা দু'তলার করিডরে রকিং চেয়ারে বসে দোল খায় তখন মাঝে মাঝে আসিফ সাবু দাদার কাছে গিয়ে গল্প করে। অনেক পুরনো দিনের স্মৃতিচারণমূলক গল্পগুলো আসিফের কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। সাবু দাদার একটি পা অচল। তাই তিনি ক্র্যাচে ভর করে হাঁটেন। যুবক বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবু দাদার এক পা অচল হয়ে যায়। তিনি চিরকুমার। কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে ফুল দেয়া প্রসঙ্গটি। সাবু দাদা কেন রাস্তায় ফুল দেয়- তা এক বিরাট রহস্য। আসিফের বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, কেন সাবু দাদা রাস্তায় ফুল দেয় আর কেন-ই বা তিনি ফুল দেয়ার পর নীরবে চোখের জল মুছেন। সাবু দাদা ভোরবেলা রাস্তায় ফুল দেয়ার পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। পেছন থেকে আসিফের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কোনো কথা বলার মতো মনমানসিকতা তার নেই। অন্তত এই মুহূর্তে। চোখ হতে পানি গড়িয়ে পড়ার স্পষ্ট রেখা দেখা যায়। আসিফ বলে, সাবু দাদা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম।

সাবু দাদা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, বল কী বলবি?

-আচ্ছা দাদা, তুমি প্রতি বছর এই দিনে এখানে ফুল দাও কেন? আবার ফুল দেয়ার পর কেনই বা নিবৃতে চোখের জল ফেল?

সাবু দাদা বাঁ হাতের উল্টো দিক দিয়ে চোখ মুছেন; বলেন- এই প্রশ্নের উত্তরটা আমি আজো বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি স-য-ত-নে। কাউকে কখনো বলিনি। কিন্তু আজ তোকে বলব। আয় আমার সঙ্গে।

রাস্তার পাশে বিরাট জামগাছের তলায় একটা বন্ধ দোকান। সামনে কাঠের টুল। টুলে দুই দাদা-নাতি পাশাপাশি বসে। নভেম্বরের ভোর বেলা হালকা ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। চারিদিকে হালকা শীতের আবেশ। কিন্তু সাবু দাদা অঝোরে ঘামছে। হৃদয় পোড়া গরম বাতাস যেন তাকে উষ্ণ করছে ক্রমাগত। সাবু দাদা বলেন, আসলে প্রতিবছর এ দিনে এখানে আমি ফুল ছিটাই না, কষ্ট ছিটাই। সারা বছর আমার মনে আস্তে আস্তে যে কষ্ট পুঞ্জীভূত হয়। বছরের এই একটি দিনে তা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিই। আমার হৃদয় হালকা হয়। আমি ভারমুক্ত হই। একটু রিফ্রেশ হই।

আসিফ সাবু দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছুই বুঝলাম না দাদা। সাবু দাদা মাটির দিকেই স্থির দৃষ্টি রেখে বলেন, না বুঝারই কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়ি। ঢাকায় আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ ছিল না। দূর সম্পর্কের এক চাচা আমাকে একটা লজিংয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি যাকে পড়াতাম তার বড় বোন রুনু। রুনু আমাকে কোন ফাঁকে ভালোবেসে ফেলে। নিজের পড়ালেখার চাপ, অন্যকে পড়ানোর ব্যস্ততায় ভালোবাসার ব্যাপারটা প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। একপর্যায়ে আমিও তার প্রেমে পড়ে যাই। রুনু আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। তার বাবা-মায়ের আড়ালে পিঠাপুলি রেখে দিত। জমানো টাকা দিয়ে আমার টিউশন ফি মিটিয়ে দিত। কলেজ ফাঁকি দিয়ে রিকশা করে ঘুরে বেড়াত। কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেঞ্চিতে বসে বাতাম খেতাম। দু'চার দিন আমাকে না দেখলে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলত। একদিন হয়েছে কী, রাত বারোটার দিকে আমি সবে মাত্র শুয়েছি। ঘুম আসছিল না। মিটমিট করে তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে। এমন সময় বাহির হতে দরজায় টোকা। আমি জিজ্ঞাস করলাম- কে?

'আমি।' কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম রুনু। রুনু প্রায়ই এমন সময় এক গস্নাস দুধ কিংবা কোনো ফল নিয়ে আসে। এটা আমার প্রতি রুনুর অতি মায়া। দরজা খুলে দিলাম। রুনু এক গস্নাস দুধ নিয়ে রুমে ঢুকল। আমি দুধ খেতে অস্বীকার করলাম। বললাম, রুনু, এভাবে প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছো। এতে তো আমার ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আমাকে আর কত ঋণী করবে তুমি?

রুনু কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে ওর দিকে তাকালাম। আজ তাকে অন্য রকম লাগছে। দু'ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়া, সারা মুখে মেক-আপের চিহ্ন। কোনো প্রশ্ন করার আগেই রুনু বলে, সাবু, আজ আমিও এ রুমে থাকব। রুনুর কাজল কালো চোখের দিকে তাকালাম। সোনালি রঙের ছড়ানো চুলগুলো কানের দুপাশে তরতর করে কাঁপছিল। মাঘ মাসের মধ্যরাত্রিতেও এক অজানা ভালো লাগা মুহূর্তেই আমাকে উষ্ণ করে দিল। কপালে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম জমছিল। কিন্তু নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে সামলে নিয়ে বলি- রুনু, তুমি কী পাগল হয়ে গেলে? সে বলে, সাবু- তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না। তুমি ছাড়া আমার পুরো পৃথিবী শূন্য লাগে।

সেদিন অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ফেরত পাঠিয়েছিলাম। কত পাগলামি-ই না করত মেয়েটা। সাবু দাদা আবারো বাম হাতের আঙুল দিয়ে দুচোখ কচলায়, তোয়ালে দিয়ে চোখ মুছে। একটি গরম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কিছুক্ষণের জন্য তিনি নীরব হয়ে যান। তারপর আবার বলেন, আমি জানতাম, রুনুর মা-বাবা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেবে না, বড় লোক বলে কথা। তারপরও রুনুকে বলি, বিষয়টা তার মাকে জানাতে। রুনুর মা বলেন, এ কথা তোর বাবা শোনলে তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। রুনু বলে, সাবু- এভাবে কাজ হবে না। তাই পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন রাত দশটার দিকে আমরা বাসা হতে বেরিয়ে আসি। ট্রেনে করে মধ্যরাতে ময়মনসিংহ রেলস্টশনে এসে নামি। অনেক কষ্টে একটা রিকশা মেনেজ করি। রিকশায় উঠে বসি। অপরিচিত জায়গা, বাসা হতে বেরিয়ে আসা, মধ্যরাত্রি, সবমিলিয়ে রুনু ভয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। ভাবলাম-মা-বাবা একটা অপরিচিত মেয়েকে দেখে নিশ্চয় আশ্চর্য হবেন। কিন্তু আমার মা-বাবাকে তো আমি চিনি। তারা অবশ্যই হাসিমুখে সব মেনে নেবেন। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা ট্রাক আমাদের রিকশাকে প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা দেয়। তারপর ঠিক কি হলো বুঝতে পারিনি। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন বুঝতে পারি রাস্তার নিচে আমি পড়ে আছি। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। অনেক কষ্টে ঘাড় উঁচিয়ে দেখি রুনু রাস্তার মাঝখানে পড়ে রয়েছে। ক্ষীণ কণ্ঠে গোঙাচ্ছে আর সাবু সাবু বলে ডাকছে। উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি আমার শরীরে ছিল না। সরিসৃপ প্রাণীর মতো বুকের ওপর ভর দিয়ে রাস্তায় উঠে এলাম। তখন আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অকোতোভয় এক যোদ্ধা। রুনুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি- ওর কোমর থেকে নিচের অংশ একেবারে থেঁতলে দিয়েছে ঘাতক ট্রাক। আমি এতটুকু ভয়ও পাইনি। শুধু আমার আর রুনুর মাঝে চার হাত জায়গাই আমার কাছে চার কিলোমিটার দূরের পথ মনে হচ্ছিল। কনুয়ের ওপর ভর দিয়ে ওর কাছে আসি। রুনুর মাথা আমার কোলের ওপর রাখি। আমার চোখের জল তখন শুকিয়ে গেছে। রুনু আমার কোলে মাথা রেখে বলে- সাবু, আমি ভালোবেসে যে ফুল ফুটিয়েছি। তার ঘ্রাণ পাওয়া হলো না। তুমি আমাকে কথা দাও। আমাকে অনেক ফুল এনে দেবে। যে ফুলের ঘ্রাণে আমার প্রাণ জুড়াবে। ফুল....., অনেক ফুল...........!

সাবু দাদা আবার একটা দম নিয়ে বললেন-একথা বলতে বলতে আমার রুনু আমাকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। তাই এই একটি নির্দিষ্ট দিনে রুনুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এখানে ফুল দিতে আসি প্রতি বছর।

সদস্য

জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

ময়মনসিংহ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71133 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1