বুয়েট থেকে বাড়ি ফেরার সময় বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিপন। এত এত গাড়ির ভিড়ে বাসায় যাওয়ার মতো একটি গাড়িও পাচ্ছে না। একটুপর একটি রিকশাকে কাছে আসতে দেখে সে হাত উঁচিয়ে থামায়। তার বাসা পর্যন্ত রিকশা ভাড়া কত জিজ্ঞেস করলে রিকশাওয়ালা ৮০ টাকা বলল। রিপন আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রিকশায় চড়ে বসলো।
রিকশায় বসে সে মনে মনে ভাবতে লাগল- পলাশী মোড থেকে আমার রিকশা ভাড়া কম করে হলেও ১০০ টাকা। কিন্তু লোকটা চাইল মাত্র ৮০ টাকা। মনের মধ্যে একটা খটকা লাগল। রিকশায় উঠার সময় লোকটার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করে সে।
বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ হবে। গায়ে যেনতেন একটি জামা আছে। মাথায় গামছা পঁ্যাচানো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মুখমন্ডল দেখে মনে হচ্ছে রোদে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে রিপনের চোখে চোখ পড়তেই মনে হয় সে চোখে জগতের অসীম স্বপ্ন। কৃষ্ণবর্ণের মুখমন্ডল জুড়ে শুরু থেকেই অকৃত্রিম হাসি লেগে আছে।
রিকশা যখন রিপনদের বাসার কাছাকাছি চলে আসে তখন সে কৌতূহল বশত তাকে জিজ্ঞেস করল,
- চাচা, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
\হলোকটা উত্তর দিল,
- নোয়াখালীতে।
- নোয়াখালীর কোথায়?
- হাতিয়া উপজেলায়।
রিপন একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
- কি বলেন! আমাদের বাড়িও তো নোয়াখালীর হাতিয়ায় ছিল।
এই কথা শোনার পর লোকটা পেছন ফিরে রিপনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- আমার বাড়ি আফাজিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে। ফরায়েজি গ্রামে। আপনাদের গ্রামের নাম কী?
- গ্রামের নাম কী ছিল আমি তা বলতে পারব না। তবে আমার আব্বু-আম্মু জানেন। আসলে ঈদে কিংবা লম্বা কোনো ছুটি পেলে আমরা দুই-তিন বছর পরপর দাদুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। আমার জন্মের পর থেকে আমরা এখানেই সেটেল্ড।
- আপনার আব্বুর কি নাম?
- ছৈয়দ মিয়া।
- আপনার দাদুর বাড়ি কী ছৈয়দিয়া বাজারের পাশে।
- হঁ্যা, আমার মনে পড়েছে। দাদুদের বাড়ির পাশেই ছৈয়দিয়া বাজার আছে।
- তাহলে চিনতে পেরেছি। আপনার দাদার নাম মোতালেব মিয়া। এলাকায় উনার বেশ নামডাক আছে।
অল্প সময়ের মধ্যে রিপনের কাছে লোকটাকে খুব আপন বলে মনে হতে লাগল।
এরপর রিকশাওয়ালাটা রিপনকে জিজ্ঞেস করল,
- প্রতিদিন কি এইপথ দিয়ে ক্লাসে যাওয়া-আসা করেন?
- না, আমি পাস করেছি ৩ বছর হলো।
- ওহ্ আচ্ছা! এখন কি করেন?
- চাকরি করি।
- বেশ! আমার ছেলেও বুয়েটে পড়েন। এবার ফাইনাল ইয়ারে।
\হলোকটার কথাগুলো শুনে রিপনের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কত কষ্ট করে রিকশা চালাচ্ছেন। আবার বলছেন, তার ছেলে নাকি বুয়েটে পড়ে। রিপন লোকটার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- বুঝলাম না, চাচা। আপনার ছেলে বুয়েটে পড়ে!
- হঁ্যা, বাবা।
রিকশায় বসে বসে রিপন লোকটার কথার অংক মিলাতে পারছে না। তাই আরেকটু একটু পরিষ্কার হতে ডিটেইলস জানতে চাইল,
- চাচা, ও কোন ডিপার্টমেন্ট পড়ে?
- সে সিভিলে পড়ছে।
রিকশাওয়ালা লোকটার ঠিক ঠিক উত্তরে রিপন নির্বাক থাকে। আর মনে মনে ভাবে- আসলেই তো রিকশাওয়ালা চাচার ছেলে বুয়েটে পড়ে!
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চুপচাপ বসে থাকার পর সে নীরবতা ভেঙে বলল,
- চাচা, আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?"
- ২ ছেলে, ১ মেয়ে।
- ওরা কী করে?
- ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে আর মেয়ে ইডেন কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।
রিপন লোকটার সঙ্গে যতই কথা বলছে ততই চমকিত হচ্ছে।
আলাপ করতে করতে তারা এক সময় বাসার কাছাকাছি চলে আসে। রিপন রিকশা থেকে নেমে বলল,
- আপনি আগে কি করতেন, চাচা?
\হলোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
- গ্রামের বাজারে আমার ছোটখাটো একটি কাপড়ের দোকান ছিল। ব্যবসায় হঠাৎ করে মন্দা শুরু হয়। এতদিনে যা কিছু জমা ছিল সব শেষ হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে আমরা নদীভাঙনের কবলে পড়ি। চারদিকের ধাক্কা সামলে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শেষমেষ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে নিরুপায় হয়ে এই রিকশা হাতে নিয়েছি। সেই থেকে এই রিকশাই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ধরা দিয়েছে। কিন্তু আঙ্কেল, রিকশা চালানো নিয়ে আগে কেউ আমায় কিছু বলতো না। ইদানীং কিছুলোকে বলাবলি করে, 'তোমার ছেলে তো এখন বুয়েটে পড়ে। তোমার আর রিকশা চালানোর কি দরকার?'
কিন্তু কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমারটা তো আমি বুঝি। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সংসারের খরচ চালাতে হয়। বড়ছেলে টিউশনি করে নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিলেও বাড়ির সবার সবকিছু আমায় দেখতে হয়।
রিকশাওয়ালা চাচার দুর্দিনের গল্প শুনে রিপন ব্যথিত হয়।
তারপর কৌতূহলী হয়ে বলল,
- আপনার বড়ছেলের বুয়েটে ভর্তি প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন।
রিকশাওয়ালা চাচা মাথার গামছা নিয়ে মুখমন্ডল, কপাল মুছতে মুছতে হাসিমাখা কণ্ঠে বললেন,
- আমার ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো। ক্লাস ফাইভে ও এসএসসিতে বৃত্তি পেয়েছে। তারপর এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। এইচএসসি পাস করার পর শহরে এসে নিজে নিজেই ভর্তি কোচিং করেছে। এরপর একে একে চুয়েট, কুয়েট, বুয়েটসহ আরো অনেক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। শুনেছি সে সব জায়গায় টিকেছিল। ওর বুয়েটে টিকে যাওয়ার খবর এলাকায় প্রচার হয়ে গেলে নানান জনে নানান মন্তব্য করত। কেউ কেউ বলতো, 'বাদ দাও, ওসব বড়লোকের ছেলেমেয়েদের জন্য। তুমি গরিব মানুষ। ওখানে পড়াতে বড়লোকেরাই রীতিমতো হিমশিম খায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দাও। তাহলে নিজেও চলতে পারবে। তোমার জন্যও কিছু পাঠাতে পারবে।' আবার কেউ কেউ বলতো, 'বুয়েটে যখন টিকে গেছে তখন কষ্ট করে হলেও ভর্তি করিয়ে দাও। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও পরে দেখবে ও নিজেই দাঁড়িয়ে যেতে পারবে।'
আমি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভালো মানুষদের কথামতো।
খরচাপাতির ভয়ে আমার ছেলেও শুরুতে বুয়েটে ভর্তি হতে চায়নি। ও আমাকে একবার বলেই ফেলল,
- বাবা, আমি তো ভার্সিটিতে টিকেছি। বুয়েটে পড়তে অনেক খরচ হবে। এত টাকা তুমি কোথায় পাবে? তার চেয়ে ভালো- আমি ভার্সিটিতে কোনো একটা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে যাই।
ওর কথাশুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি রেগে গিয়ে সেদিন ওকে বলেছিলাম, বুয়েটে যখন টিকেছো তখন চোখ বন্ধ করে বুয়েটেই ভর্তি হবে। কে কি বলল সেদিকে খেয়াল করার দরকার নেই। একটা কথা শুধু মনে রাখবে, তোমার বাবার দেহে যতক্ষণ শ্বাস থাকবে ততক্ষণ খরচাপাতি নিয়ে তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। আরেকটা কথা, বাড়ি নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তুমি শুধু তোমার কাজটা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারপর ওকে বুয়েটে ভর্তি করিয়ে দেই।
- চাচা, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আগে গ্রামে রিকশা চালাতেন। কখন শহরে এসেছেন?
- ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করানোর পর থেকে আমি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। মাথায় সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা ভর করত। না জানি কোন অঘটন হয়ে যায়। প্রতিদিন দুর্ঘটনার খবর শুনতাম। শহরে প্রতিদিনই কারো না কারো বুকের মানিক অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। এসব ভাবনা থেকে শহরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। শহরে এসে রোজ আমার ছেলেকে নিজে রিকশা করে নিয়ে যাই। আবার রিকশা করে নিয়ে আসি। দিনের বাকি সময়ে রিকশা চালিয়ে যা পাই তা দিয়ে বউ-বাচ্চা সবাইকে নিয়ে পলাশী মোড সংলগ্ন ছোট্ট একটি রুমে সুখেই আছি। এতক্ষণ একজন আদর্শ স্রোতার মতো রিকশাওয়ালা লোকটার কথা শুনলো রিপন। সে মনে মনে বিড়বিড় করে রিকশাওয়ালা চাচাকে সেলু্যট জানায়।
রিকশা বাসার সামনে এসে থামলে রিপন রিকশা থেকে নেমে বলল,
- চাচা, আমার সঙ্গে বাসায় চলেন। বাসায় আজ আব্বু-আম্মু নেই। দু'জনেই টঙ্গীতে আমার খালার বাসায় বেড়াতে গেছেন। আজ আপনি আমার সঙ্গে ভাত খাবেন। আজ আমি নিজে রান্না করে আপনাকে খাওয়াব। আপনি একজন গর্বিত পিতা। আপনি রিকশাটা সাইড করে আমার বাসায় আসেন।
রিকশাওয়ালা লোকটা বললেন,
- না, বাবা! তোমার আব্বু-আম্মু বাসায় নাই। আজ থাক, অন্য একদিন আসলে খাব।
রিপন প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখে সবমিলিয়ে পাঁচশ পঞ্চাশ টাকা আছে। সে সব টাকা রিকশাওয়ালা লোকটার হাতে দিয়ে বলল,- এইটা আপনি রাখেন।
টাকা হাতে নিয়ে লোকটা রিপনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
- এত টাকা কেন, আঙ্কেল! আমাকে আশি টাকা দিন। রিপন হাসতে হাসতে বলল,
- ওগুলো আপনার কাছে রেখে দিন। বেশিদিন নয়; আরমাত্র ৬ মাস! তারপর থেকে আপনার আর কষ্ট করা লাগবে না। আপনার ছেলে বুয়েটে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে! সামনে আপনার সুদিন।
লোকটা রিপনের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।
সদস্য, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম চট্টগ্রাম