শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফজিলত

মো. মাঈন উদ্দিন
  ২১ মে ২০১৯, ০০:০০

আজ পনের দিন ধরে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত কুবের। দুর্বল শরীর নিয়েই সে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামে। এটাই তার জীবিকার একমাত্র সম্বল। হাতে টাকা-কড়ি কিছুই নেই। নিজের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা দরকার। কুবেরের চার মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে চারটাকে অনেক কষ্টে বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা চার বছর আগে বস্নাড ক্যান্সারে মারা যায়। সে বেঁচে থাকলে আজ আট বছর বয়স হতো। ছেলেটাকে বাঁচাতে কুবের অবশিষ্ট সম্পত্তি যা ছিল, সব বিক্রি করে দেয় কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কুবেরের ছোট ভাই সাবের চৌধুরী ঢাকার ধানমন্ডিতে সপরিবারে থাকে। সে কুবেরের মতো হতভাগা নয়। মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার। ধানমন্ডিতে পাঁচতলা বাড়ির মালিক। নামের শেষে চৌধুরী টাইটেল লাগিয়েছে। সাবের চৌধুরী গ্রামের বাড়ি আসে মাত্র দুইবার। রমজানের ঈদের দিন জাকাত প্রদান করতে, আর কোরবানির ঈদে কোরবানি দিতে।

আজ ঈদের দিন। ভোর হতেই ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি। পটকা ফোটার শব্দ। চারিদিকে আনন্দধ্বনি-'রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'। বাহিরে অগণিত মানুষের জমায়েত। সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জাকাতের কাপড়ের আশায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাবের চৌধুরী চলে আসবে। সঙ্গে থাকবে জাকাতের জন্য সারি সারি কাপড়। নতুন কাপড় পাওয়ার আশায় সবার মুখে আনন্দের হাসি। আনন্দের ছোঁয়া লাগেনি কেবল কুবেরের জরাজীর্ণ ঘরটিতে। সকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে কুবেরের ঘরে কিন্তু সেই আলোকে কোনো উচ্ছলতা নেই, নেই কোনো আনন্দের মিশ্রণ। কুবের ছটফট করছে জ্বরে। তার স্ত্রী অর্ধভাঙ্গা একটি জগে করে পানি ঢালছে মাথায়। আজ ঈদের দিনে ঘরে খাবার বলতে কিছু নেই। গতকাল তার মেঝো মেয়েটা কিছু সেমাই আর চিনি দিয়ে গিয়েছিল তাই মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে চৌকির এক কোণে।

সাবের চৌধুরীর গাড়ি বহর বাড়িতে প্রবেশ করল। সারিবদ্ধ মানুষের মধ্যে নতুন করে আনন্দের ঢেউ লাগল। পাশের বাড়ির মাতবর চাচাও স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন এই জাকাত প্রদান অনুষ্ঠানে। কাপড় বিতরণ শেষ হলো। মাতবর চাচার চোখ যেন কী খুঁজছে। তিনি মনে মনে বললেন, 'সবাইকে দেখলাম কিন্তু সাবেরের বড় ভাই কুবেরকে দেখলাম না যে!' তিনি কুবেরের জীর্ণ ঘরে প্রবেশ করলেন। গামছা দিয়ে কুবেরের মাথা মুছছে তার বউ। মাতবর চাচা বললেন, 'জাকাত বিতরণ অনুষ্ঠানে তোমাকে তো দেখলাম না যে কুবের?' কুবের কাঁপা কণ্ঠে বলল, 'চাচা, পনের ষোল বছর আগে একদিন আমার বউ আর সাবেরের বউয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। সেদিন থেকে সাবের আমাদের খোঁজ নিবে তো দূরে থাক, কথাই বলে না। অদৃষ্টির পরিহাসে আজ আমি রিকশাচালক আর সাবের ফ্যাক্টরির মালিক। চাচা, এই সাবেরকে আমি নিজ হাতে বর্ণমালা শিখাইনি? নিজ কাঁধে উঠিয়ে স্কুলে নিয়ে যাইনি? নিজ অংশের সম্পত্তি বিক্রি করে ফরম পূরণের টাকা দিইনি? সাবের হয়তো তখন ছোট ছিল, এখন মনে নেই; কিন্তু আপনারা কী অস্বীকার করতে পারবেন? আজ। আজ আমি নিঃস্ব। ভিক্ষুকের লজ্জা হয় না অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইতে। আমারও লজ্জা হবে না সাবেরের হাত থেকে জাকাতের কাপড় নিতে কিন্তু সাবেরের লজ্জা হবে বড় ভাইয়ের হাতে ভিক্ষা দিতে, তাই যাইনি।' মাতবর চাচা নীরবে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

সাবের চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, 'সাবের, তোমার ভাই কুবেরের কোনো খোঁজ তুমি নিয়েছ? তাকে নতুন কাপড় দিয়েছ? সাবের চৌধুরী উত্তর দিল, 'চাচা, যারা লাইনে দাঁড়িয়েছে সবাইকে তো দিয়েছি। প্রত্যেকের ঘরে কাপড় দেয়া কি সম্ভব? মাতবর চাচা দাঁতে দাঁত কাটলেন। বললেন, 'তুড়ি মারি তোমার জাকাত প্রদানকে। এই রোজার মাসেও তোমার মন-মানসিকতার কোনো পরিবর্তন আসেনি। আরে হতভাগা, নিজের ভাই এই ঈদের দিনে অভুক্ত, সে রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার কোনো খোঁজ না নিয়ে, প্রতিবেশীর হক আদায় না করে, জাকাতের কাপড় বিতরণ করলে এই দানে কতটুকু ফজিলত হবে? মনে রেখো, দান ঘর থেকে শুরু হয়।

সদস্য, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

\হময়মনসিংহ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50326 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1