শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিষ্ঠুর প্রতিশোধ

মো. মাঈন উদ্দিন
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

রান্না ঘরের লাগুয়া রুমটিতে শুয়ে আছেন ষাটোধ্বর্ বৃদ্ধা মজিলা বেগম। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে তার। বঁাশের চাটাইয়ের বেড়ার ফঁাক গলে শীতের তীব্রতা প্রবেশ করছে ঝঁা ঝঁা করে। বেড়ার ওপর দিকে বেলকির ছিন্নভিন্ন অংশ যা দিয়ে আকাশের মিটিমিটি তারার আবছা আলো দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো। তোশকবিহীন কাঠের বিছানায় পিঠে অসহ্য ব্যথা হয়। গায়ে জড়ানো কঁাথাকে মনে হয় পানিতে চুবিয়ে আনা।

প্রকৃতির ডাক মধ্যদুপুর আর মধ্যরাত বোঝে না। যখন তার সময় হবে তখনই সে ডাক দেবে, যার ব্যত্যয় হয়নি আজও। এই মধ্যরাত্রিতে প্রকৃতির ডাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য হন মজিলা বেগম। কিন্তু অন্ধকারে হাতড়িয়েও বদনা পান না তিনি। ঠাÐায় কঁাপছে মজিলা বেগমের সমস্ত হাত-পা। কঁাপা কণ্ঠে তিনি নাতিদের ডাকেন, ‘বদনাটা কই রাখছস রে? তগর জ্বালা আর ভাল্লাগে না।’ কিন্তু মজিলা বেগমের ক্ষীণ কণ্ঠের ডাক পৌঁছে না উঠানের ওপাড়ে হাফবিল্ডিংয়ে শুয়ে ঘুমানো পুত্র, পুত্রবধূ কিংবা নাতিদের কানে। অন্ধকারে বদনা খেঁাজে টয়লেটে ঢোকার আগেই কাপড় ভিজিয়ে ফেলে মজিলা বেগম। শীতের তীব্রতায় ঠকঠক করে কঁাপেন তিনি। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই কঁাথার নিচে ঢোকেন। শীত থেকে নিজেকে লুকানোর ব্যথর্ চেষ্টা করেন। কঁাথা দিয়ে নাক অবধি ঢেকে ছানাভরা চোখে মিটমিট করে তাকালেন খড়ের চালার দিকে। চালা থেকে ঘন কুয়াশা ফোটা হয়ে টপ করে পড়ে যায় তার কপালে। আবার কেঁপে ওঠেন মজিলা বেগম। প্রকৃতির এহেন বৈরী আচরণে তিনি রাগে চোখ বন্ধ করেন। ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস! স্বামীর হাতে নিমির্ত হাফ বিল্ডিংয়ের দুটো রুমের একটিতেও জায়গা হয়নি আজ মজিলা বেগমের। একটিতে থাকে একমাত্র পুত্র-পুত্রবধূ। অন্যটিতে নাতি-নাতনি। আজ সময়ের পরিবতের্নর সঙ্গে মজিলা বেগমের ঠঁায় হয়েছে রান্না ঘরের পাশের এই জীণর্ ঘরটিতে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এই হাড় কঁাপুনি শীতের রাতে শ্রদ্ধেয় ও গুরুজন হিসেবে তারই হাফবিল্ডিং ঘরে গরম কম্বলের নিচে থাকার কথা ছিল; কিন্তু সেই কম্বলের নিচে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তার পুত্র-পত্রবধূ। আর এই মাঘের শীতে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। পুত্রবধূ মজিলা বেগমকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। একমাত্র পুত্রকেও তিনি সু-পুত্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি। পুত্রকেই বা দোষ দেবেন কি করে; পুত্র তার বধূকে কিছু বলতে গেলেই বধূ পুরো বাড়িটাই মাথায় তুলে নেয়। মজিলা বেগমের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীঘর্শ^াস। পুত্র বা পুত্রবধূকে নয়; অবশেষে তার কপালকেই দোষ দেয়। দোষ যে তার নিজেরও আছে। তিনি অনুশোচনায় আবারো দুচোখ বন্ধ করেন। বহিচর্ক্ষু বন্ধ করলেও মানস চক্ষু তার ঠিকই খোলা। সে চক্ষু দ্বারা হৃদয়ের করিডোরে ছড়ানো বিশাল ক্যানভাসে যে ছবি ভেসে উঠছে তা তিনি স্পষ্ট দেখতে পান।

আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে। মজিলা বেগম তখন টাগরা যুবতী ছিলেন। শ^শুর তার বিয়ের আগেই মারা যান। এ সংসারে তিনি স্বামী ও পঞ্চাশোধ্বর্ শাশুড়িকে পান। মজিলা বেগম শাশুড়িকে সংসারের আপন মনে করতেন না। ওই বৃদ্ধা কবে মরবে; কবে তিনি আছান পাবেনÑ এই চিন্তাই তিনি অস্থির থাকতেন। বৃদ্ধার শরীর থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোয় বলে তিনি তার শাশুড়ির বিছানা রান্নাঘরে স্থানান্তর করেন। তখন তিনি ভাবতে পারেনি তার শাশুড়ি কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন। যেটা তিনি আজ মমের্ মমের্ উপলব্ধি করছেন। তিনি ফিসফিস করে বললেন, প্রকৃতিই আজ প্রতিশোধ নিচ্ছে। আহা! প্রকৃতির প্রতিশোধ কত নিষ্ঠুর; কত নিমর্ম!

শীতের সকালে, হালকা রোদে নিজেকে উষ্ণ করার প্রয়াসে মজিলা বেগম সূযের্র মুখোমুখি বসে আছেন। এই সকালে ঘুম আসার কথা নয়; অথচ কোনো এক অজানা কারণে তার দুচোখে ঘুমপরীরা ভর করেছে, তিনি বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। রাতে বিছানা ভেজানোর কারণে পুত্রবধূ এই সাত-সকালেই তাকে বকাঝকা করেছে। এই বকাঝকাই প্রাপ্য হিসেবে তিনি মাথা পেতে নিয়েছেন। তিনি আজ বাকরুদ্ধ। তার মন গুমরে গুমরে কেঁদেছে, কিন্তু চোখ জোড়া একেবারেই কঁাদেনি। কান্নার যে ভাষা সে ভাষা শুধু মন নয়, চোখও হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ যে নেবেই, প্রকৃতির প্রতিশোধ যে অলঙ্ঘনীয়Ñ এটা তিনি বোঝে গেছেন। মজিলা বেগম একমাত্র নাতিকে ডেকে বললেনÑ শোনো দাদুভাই, পিতামাতাকে কখনো কষ্ট দেবে না। বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করো। সেবাযতœ করো। যদি না করো তা হলে মনে রেখো, প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেবেই। আর প্রকৃতির প্রতিশোধ যে বড়ই নিষ্ঠুর! মজিলা বেগম জানেন, এই কঠিন কথাগুলি বোঝার বয়স তার নাতির এখনো হয়নি; তবুও তিনি বলে চললেনÑ আমি চাই না আমার মতো ভুল কেউ করুক; আর প্রকৃতি তার ওপর কঠিন প্রতিশোধ নিক; প্রকৃতির প্রতিশোধ যে বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই বেদনার।

সদস্য

জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

ময়মনসিংহ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<35271 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1