মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আপনার শিশুর বেড়ে ওঠা

শিশুর বিকাশের ব্যাপারে বাবা-মা উভয়ের ভূমিকাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দু'জনেরই উচিত শিশুর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করা। কখনোই শিশুর ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত শাসন চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এতে তার বিকাশ যেমন ব্যাহত হবে তেমনি ভবিষ্যতে সে হয়ে উঠবে মেরুদন্ডহীন।
নতুনধারা
  ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শিশুর বিকাশের ব্যাপারে বাবা-মা উভয়ের ভূমিকাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দু'জনেরই উচিত শিশুর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করা। কখনোই শিশুর ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত শাসন চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। এতে তার বিকাশ যেমন ব্যাহত হবে তেমনি ভবিষ্যতে সে হয়ে উঠবে মেরুদন্ডহীন।

কখনোই একটি শিশুর সঙ্গে আরেকটি শিশুর তুলনা করা যাবে না। এতে করে তার ভেতরে তৈরি হবে ক্ষোভ, হতাশা ও প্রতিহিংসা।

'আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে। আমরা তার একটি সাজানো বাগান চাই। আজ যে শিশু মায়ের হাসিতে হেসেছে। আমরা চিরদিন সেই হাসি দেখতে চাই।'

আমার খুবই প্রিয় একটি গানের প্রথম চারটি লাইন দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করলাম। শিশুরা একটি পরিবারে হাসি-আনন্দের অফুরন্ত উৎস। তার আধো আধো বোল, তার হাসি, তার দুষ্টামি সব কিছু আমাদের আনন্দ দেয়। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন সে বড় হতে থাকে তখন। আমরা তাকে নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে ফেলার চেষ্টা করি।

আমরা তার কাছে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ আশা করি। মনে করি, আমরা বড়রা যা করছি আমাদের বাড়ির শিশুটিও তেমনটি করবে। তাই বাবা-মা ভাইবোন কিংবা দাদা-দাদি বা অন্য আত্মীয়স্বজন তাকে সারাক্ষণ বলতে থাকে, এই এটা করো না, সেটা করো না, ওখানে যেও না, কী দুষ্ট ছেলেরে- বাবা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে শিশুর মনস্তত্ত্ব এবং তার বেড়ে ওঠার ব্যাপারে আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবই হচ্ছে এর প্রধান কারণ।

মানুষের মস্তিষ্ক ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপরিপক্ব থেকে যায়। এই বয়সের আগ পর্যন্ত আসলে সে যা করছে তা আসলে তার অপরিপক্ব মস্তিষ্কের কারণেই করছে।

শিশুর দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ

এখন আমরা আলোচনা করব শিশুর ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমবিকাশের সংক্ষিপ্ত চিত্র। তবে কোনো কোনো শিশুর বৃদ্ধির বিকাশ এই বয়সের আগে বা পরে অর্জিত হতে পারে।

জন্ম থেকে ১ মাস বয়স

এ সময় শিশু দিনে ৫-৮ বার খাবে। ঘুমাবে ১৮-২০ ঘণ্টা। এ সময় সে দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, তাপ ও ব্যথার অনুভূতি পৃথক করতে পারে।

২-৩ মাস বয়স

এ বয়সে সে রঙ চিনতে পারে, মুখ দিয়ে বিভিন্ন শব্দ করে। চোখের মাংসপেশিতে তার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। হাত উঠিয়ে নাড়াচাড়া করে। ক্ষুধা পেলে কাঁদে। খুশি হলে হাসে।

৪-৬ মাস বয়স

এ সময়েই তার মাকে চিনতে পারে। পরিচিত এবং অপরিচিতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ করে। দিনে ৩-৫ বার খায়। মাথা এবং বাহুর নড়াচড়ায় তার একটা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। উঠে বসতে চায়। অনেক শিশু এ বয়সে বসতেও পারে।

৭-৯ মাস বয়স

এ সময়টাতে শিশু হামাগুড়ি দেয়, কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়াই বসতে পারে। মায়ের সঙ্গে তার বিশেষ মানসিক সম্পর্ক তৈরি হয়। মায়ের কাছ থেকে আলাদা হলেই কাঁদতে থাকে।

১০-১২ মাস বয়স

এ সময় শিশু তার হাত-পায়ের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উঠে দাঁড়াতে পারে। হাঁটতে পারে। কোনো কোনো শিশু দৌড়াতেও পারে। দু-একটা শব্দ বলতে পারে। বিভিন্ন শব্দ বা ঘরের কারো অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করতে পারে। এ সময়টাতে সে তার নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়। ছোটখাটো আদেশ-নির্দেশ বুঝতে পারে। রাগ, অপরিচিত ব্যক্তি বা প্রাণী বা বস্তুর ভয়, কৌতূহল, আবেগ, অনুভূতি এ সময়েই বাড়তে থাকে। পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলতে চায়। 'না' বলা বুঝতে পারে। জিনিসপত্র আদান-প্রদান করতে পারে।

১-১/২ বছর বয়স

সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, হাঁটা, দৌড়ানো, কাগজে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটা, সব কিছু এই বয়সেই শিশুরা করতে পারে। মা তাকে ছেড়ে কোথাও গেলে ভীষণ মন খারাপ করে। গোসল করতে চায় না। অল্প কিছু নির্দেশ মানতে পারে। কিছু শব্দের পুনরাবৃত্তি করে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পছন্দ করে। নিজে নিজে খেতে চায়।

১/২-২ বছর বয়স

এ সময় শিশু দৌড়াদৌড়ি করে। বল পা দিয়ে লাথি দেয়। লেগো সেট দিয়ে টাওয়ার বানাতে পারে। প্রস্রাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দুই শতাধিক শব্দ এ সময়ে একটি শিশু বলতে জানে। রাতে ১২ ঘণ্টা ঘুমায়। তাকে যা বলা হয়, তার উল্টোটা করতে ভালোবাসে। শিশু খেয়ালি হয়। রাগ, অভিমান করে। নতুন শিশুর প্রতি বিরক্ত হয়।

২-৩ বছর বয়স

শিশু লাফালাফি করে, তিন চাকার সাইকেলে চড়তে পারে। রঙপেনসিল দিয়ে আঁকাজোকা করে। ছোট ছোট বাক্য বানিয়ে কথা বলতে পারে। যেমন- 'আম্মু দুদু খাবো'। শিশুর কথার মধ্যে তোতলামি বা কথায় অস্পষ্টতা আসতে পারে সামান্য। মা দূরে চলে গেলে ভয় পায়। হাসি, আনন্দ, রাগে চেহারায় বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। বিভিন্ন দুষ্টামি করে। বাবা-মায়ের অনুকরণ করতে চায়। খেলনা দিয়ে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে চায়। আবার তাদের সঙ্গে ঝগড়াও করে। শিশু নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ সময়টাতে শিশু বাবা-মায়ের কথা শুনতে চায় না।

৩-৪ বছর বয়স

শিশু একপায়ে দাঁড়াতে পারে। ওপর-নিচে লাফালাফি করে। বৃত্ত এবং ক্রস আঁকতে পারে (৪ বছর বয়সে)। ঘরের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বাবা-মায়ের প্রতি টান অনুভব করে। তাদের ছেড়ে দূরে যেতে চায় না বা তারা তাকে ছেড়ে দূরে গেলে ভীষণ কষ্ট পায়। তবে ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের প্রতি এবং মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে বাবার প্রতি টান বা অনুরাগ বেশি দেখতে পাওয়া যায়। অন্ধকার নিয়ে অহেতুক ভয় থাকে। অন্য শিশুদের সঙ্গে দলবেঁধে খেলতে ভালোবাসে। অন্য শিশুদের শরীরের প্রতি কৌতূহল থাকে। এ সময় কারো কারো কাল্পনিক বন্ধু থাকে। সেটা হতে পারে রূপকথা বা কার্টুন কিংবা টিভি সিরিজের কোনো চরিত্র, যেমন- ডালিমকুমার, হ্যারিপটার, আলাদীন কিংবা টম অ্যান্ড জেরি অথবা স্পাইডারম্যান, নিজা টার্টেলস, স্কুবিডু ইত্যাদি। এ বয়সটিতেই শিশুরা তার কল্পনার জগৎ তৈরি করে।

৪-৭ বছর বয়স

এ বয়সটাতে শিশু অনেক কাজ নিজে নিজে করতে শেখে, যেমন- বাথরুম করা, টুথব্রাশ করা, নিজে নিজে কাগজ পড়া, চুল আঁচড়ানো, জুতার ফিতা বাঁধা ইত্যাদি। এ সময় শিশুর কথাবার্তা হয় জড়তাহীন। দুই হাজারের বেশি শব্দ সে জানে। এই বয়সে শিশু কিছুটা দায়িত্ব সচেতন হয়। প্রশংসা পেলে খুশি হয়। প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। এ সময় তার যে ধারণা বা বোধ গড়ে ওঠে, তাকেই সে আঁকড়ে ধরে থাকে সারা জীবন। সহজে এই ধারণা পরিবর্তন করা যায় না। জাদু দিয়ে কোনো কিছু বেড়ে যাওয়া, কমে যাওয়া বা অদৃশ্য হওয়াকে সে খুব বিশ্বাস করে। এ সময়টাতে তার বাস্তবতাবোধ জাগ্রত হয় না। এ বয়সটাতে সে নৈতিকতা খুব একটা প্রদর্শন করতে পারে না।

৭-১১ বছর বয়স

চিন্তাচেতনায় সুসংবদ্ধতা আসতে থাকে। কল্পনার চেয়ে যুক্তি প্রাধান্য পায় বেশি। এ সময়টাতে তারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। যেমন- ধাঁধা, কুইজ, সুডোকু ইত্যাদি। তা ছাড়া গাণিতিক ও জ্যামিতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও তারা করতে সক্ষম। গাণিতিক বিভিন্ন হিসাব তার মনে গেঁথে যায়। যেমন- ২+২ = ৪ কিংবা ২-২ = ০ ইত্যাদি।

৭-১৫ বছর বয়স

ভাবনা-চিন্তাগুলো আরো সুসংহত হয় যৌক্তিকতাবোধের নিরিখে। বাস্তববাদী হতে থাকে। বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কাজ করার আগ্রহ বাড়ে। বীজগাণিতিক সমস্যা সমাধানে দক্ষতা বাড়ে। যেমন- ধ+ন = ী তাহলে ী= ধ-ন। বিভিন্ন স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ বুঝতে পারে।

এতক্ষণ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হলো তা হলো শিশুর দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একটি গড়পড়তা চিত্র। কোনো কোনো শিশু সময়ের আগে অনেক কিছু শিখতে পারে। আবার অনেক শিশুর শিখতে অনেক সময় লাগে। তবে শিশুর বিকাশের ব্যাপারে বাবা-মা উভয়ের ভূমিকাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেরই উচিত শিশুর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করা। কখনোই শিশুর ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত শাসন চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। এতে তার বিকাশ যেমন ব্যাহত হবে তেমনি ভবিষ্যতে সে হয়ে উঠবে মেরুদন্ডহীন। কখনোই তার সঙ্গে আরেকটি শিশুর তুলনা করা যাবে না। এতে করে তার ভেতরে তৈরি হবে ক্ষোভ, হতাশা ও প্রতিহিংসা। তুলনা করতে হবে তার আগের কাজের সঙ্গে বর্তমান কাজের। যেমন প্রায়ই দেখা যায় বাবা-মা বলে, 'অনীক কত শান্ত ও কত ভালো, পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। তুমি এমন কেন? এত দুষ্টুমি করো, পড়াশোনা করতে চাও না।

এসব কথার ফলে যা হবে তা হলো, অনীকের প্রতি সেই শিশুটির একটা হিংসাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হবে। আর নিজে ভুগবে হীনম্মন্যতায়। তার বদলে তাকে বলতে হবে তুমি আগে কত শান্ত ছিলে, পড়াশোনা ঠিকমতো করতে। এখন এমন করছো কেন? আশা করি, তুমি আর এমনটি করবে না। এভাবে বললে সে বুঝবে। শিশুদের ব্যাপারে বাবা-মায়ের ধৈর্য অপরিহার্য। তাহলেই সে বেড়ে উঠবে সুস্থ, প্রাণোচ্ছল, মেধাদীপ্ত হয়ে। আর আপনি হবেন গর্বিত বাবা অথবা মা।

য় সুস্বাস্থ্য ডেস্ক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77241 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1