শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গরমে ত্বকের ফাঙ্গাস রোগ

ফাঙ্গাস সংক্রমণগুলোর বেশিরভাগ খুব ছোঁয়াচে বলে পরিবারের কোনো এক সদস্যের এ রোগ হলে অন্যদের সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বিশেষ করে কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র, বসার আসন ইত্যাদি ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসক দেখাতে হবে। আর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিশেষ যত্নবান হবেন। সব সময় সুতার কাপড় পরিধান করবেন।
নতুনধারা
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

প্রচন্ড গরমে তাপমাত্রা যত বাড়ে, চর্মজাতীয় রোগ তত বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাম থেকে ত্বকে ঘটতে পারে ছত্রাক বা ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। সারা দিন ধরে আন্ডার গার্মেন্টস, প্যান্ট ও জুতা পরে থাকলে সে স্থান এবং কুঁচকি, পায়ের আঙ্গুলের মাঝখানে ছত্রাক আক্রমণ করার আশঙ্কা বেশি থাকে।

যেহেতু এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে ছড়ানোর আশঙ্কা প্রবলভাবে দেখা দেয়। এ ছাড়া পোষাপ্রাণী, সেলুনে ব্যবহৃত ব্রাশ, সিনেমা হলের সিট, অন্যের ব্যবহার করা টুপি বা হ্যাট থেকেও হয়ে থাকে ফাঙ্গাস ইনফেকশন।

যেখানে হয়ে থাকে

শুধু ত্বকে নয়, এ ফাঙ্গাস নখ ও চুলেও আক্রমণ করতে পারে। এ অসুখ জীবননাশের জন্য হুমকি না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। অতিরিক্ত চুলকানি, আক্রান্ত স্থান থেকে কষ বা পুঁজ ঝরা রোগীকে সামাজিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তোলে। মাথার কোনো স্থানে হঠাৎ? গোল গোল টাক পড়াও ফাঙ্গাস থেকে হয়ে থাকে। দাড়িতে ফাঙ্গাস হলে লোমের গোড়ায় পুঁজ দেখা যায়।

চিকিৎসা

পুঁজ হয় বলে অনেকে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আসলে অ্যান্টিফাঙ্গাস ট্যাবলেট ও ক্রিম ব্যবহার করলে উপকার বেশি পাওয়া যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য রোগ নির্মূল হতে কয়েক মাস টানা চিকিৎসা করাতে হয়। মাথা, নখ ও ত্বকের এ চিকিৎ?সা একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে হওয়াই ভালো। কারণ এ ওষুধগুলো অনেকের ক্ষেত্রে নিরাপদ নাও হতে পারে।

বিস্তারিত বিশ্লেষণ

যে কোনো মানুষের ত্বকেই ফাঙ্গাস আক্রমণ হতে পারে। ত্বকের উপরিভাগে যেসব ফাঙ্গাস সংক্রমণ ঘটে তাদের মধ্যে ক্যানডিডা ও ম্যালাসেজিয়া নামক ইস্ট ট্রাইকোফাইটন, মাইক্রোস্পোরাম, ইপিভারমোফাইটন নামক ডার্মাটোফাইট প্রধান। ডার্মাটোফাইটগুলো আক্রান্ত মানুষ, রোগাক্রান্ত গৃহপালিত পশু বা সঁ্যাতসেঁতে মাটি থেকে শিশুদের দেহে স্থানান্তরিত হয়। এর মধ্যে আক্রান্ত পশু বা সঁ্যাতসেঁতে মাটি থেকে যে ডার্মাটোফাইটগুলো শিশুদের ত্বকে এসে সংক্রমণ ঘটায় তাদের আক্রমণ স্বল্পসময় স্থায়ী হয় আর আক্রান্ত মানুষ থেকে শিশুর ত্বকে যেসব ডার্মাটোফাইট কেয়ার সৃষ্টি করে তা কম তীব্রতর কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতা হয়।

মানুষের ত্বকের একেবারে বাইরের দিকে নির্জীব কেরোটিন থাকে। ডার্মাটোফাইটগুলো এ কেরোটিনকেই আক্রমণ করে এবং এখানেই বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করে। খুব কম ক্ষেত্রেই এরা ত্বকের বাইরের স্তর ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে। ত্বকের উপরিভাগে ডার্মাটোফাইটের এরূপ সংক্রমণে ত্বকের কোষগুলোর অতিদ্রম্নত সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ফলে ওই এলাকার ত্বক আঁশ আঁশ ও মোটা-পুরু হয়ে যায়। ডার্মাটোফাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ত্বকের রোগ ঘটায় যেটি, সেটি কখনও মাথার ত্বকে আক্রমণ করে না। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ১০%-২০% মানুষ এ ডার্মাটোফাইটে আক্রান্ত।

রোগ নির্ণয়

ত্বকের ডার্মাটোফাইট সংক্রমণকে সাধারণ অর্থে রিংওয়ার্স, টিনিয়া সংক্রমণ বা দাদ বলে। ত্বকের এ সমস্যাটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীর সাম্প্রতিক তথ্যাবলি জানা জরুরি। আক্রান্ত স্থান পরীক্ষা করে চিকিৎসক রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পেতে পারেন। ল্যাবরেটরিতে নিম্নলিখিত পরীক্ষা করে ডার্মাটোফাইট সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়- (১) পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড (কঙঐ) পরীক্ষা, (২) ফাঙ্গাস কালচার, (৩) উডস লাইট পরীক্ষা দেহের কোন অংশের ত্বকে ডার্মাটোফাইট সংক্রমণ হয়েছে বা দাদ হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে এদের আবার বিভিন্ন রকম নাম দেয়া হয়েছে। এখানে সেরূপ কিছু বর্ণনা করা হলো:

* টিনিয়া করপোরিস- সাধারণভাবে ত্বকের উপরিভাগে ফাঙ্গাস বা ডার্মাটোফাইট সংক্রমণ হলে তাকে টিনিয়া করপোরিস বলে। এর মধ্যে মুখমন্ডল, বুক, কাঁধ, পেট ও পিঠের ত্বক অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে ত্বকে সমতুল্য আঁশ আঁশ ও গোলাকার অংশ দেখা যায়, যার চারপাশে উঁ চু সীমানা থাকে। আর এটি এর গোলাকার চেহারা বজায় রেখেই দ্রম্নত বাড়তে থাকে। দেহের উন্মুক্ত অংশে দাদ বেশি হয়। একটি বা একাধিক দাদ একসঙ্গে কাছাকাছি বা বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। আক্রান্ত অংশ খুব চুলকায় এবং ছোট ছোট দানার মতো উঁ চু হতে বর্ণহীন জলীয় পদার্থ বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এসব জায়গায় আবার অন্য কোনো ব্যাক্টেরিয়ার সহসংক্রমণ হলে পুঁজ জমতে দেখা যায়। তবে কোনো কোনো সময় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণের জন্যও এমনটি হতে পারে।

টিনিয়া করপোরিস আক্রান্ত স্থানে মিকোনাজোল (গরপড়হধুড়ষব), কোট্রিমাজোল (ঈষড়ঃৎরসধুড়ষব), ইমিডাজোল (ওসরফধুড়ষব), বেনজাইলামাইন (ইবহুুষধসরহব) ক্রিম ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। তবে দেহের বিস্তৃত অংশে সংক্রমণ ঘটলে বা স্থানীয় চিকিৎ?সা ব্যর্থ হলে মুখে খাবার ওষুধ দিতে হবে। গ্রাইসিভ ফলোভিন ও কিটোকোনাজল জাতীয় ট্যাবলেট মুখে খাবার ওষুধ হিসেবে খুব ভালো।

* টিনিয়া পেডিস- পায়ের ত্বকে ডার্মাটোফাইট সংক্রমণকে টিনিয়া পেডিস বলে। পরিবারের কোনো একজনের পায়ে এ রোগ হলে দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীর মাধ্যমে ডার্মাটোফাইট পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আক্রমণ করতে পারে। টিনিয়া পেডিসে আক্রান্তদের পায়ের দুআঙ্গুলের মাঝের অংশ ফ্যাকাসে ও থকথকে হয়ে যায়। এখান থেকে বর্ণহীন যেন জলীয় পদার্থ নিঃসৃত হয়। জলে ভিজলে এ অংশ আরও খারাপ আকার ধারণ করে। মাঝে মাঝে বিশেষ করে বিশ্রামের সময় খুব চুলকায় এবং চুলকানোর ফলে ত্বক ফেটে যায়, উঠে আসতে থাকে। টিনিয়া পেডিস সাধারণত দীর্ঘসূত্রী ধরনের হয়। দু-আঙ্গুলের ফাঁক ছাড়াও পায়ের পাতা এবং গোড়ালিও আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত স্থানে ক্রিম লাগালে এ রোগ সেরে যেতে পারে। তবে খাওয়ার ওষুধই বেশিরভাগ সময় উপকারী। বিশেষ করে গোড়ালিতে সংক্রমণ হলে।

মুখে খাবার ওষুধ (ইন্টাফোনাজোল, ফুকেনোজোল, টারবিনাফিন ইত্যাদি) ৬-৮ সপ্তাহ খেতে হয়। টিনিয়া পেডিস থেকে রেহাই পেতে হলে চলাফেরায় সব সময় স্যাল্ডেল পরতে হবে, গণশৌচাগার জাতীয় স্নানাগার ব্যবহার করা যাবে না এবং পা সব সময় শুকনা রাখতে হবে।

* টিনিয়া ক্রুরিস- টিনিয়া ক্রুরিস হলো কুঁচকি অঞ্চলের ত্বকের ফাঙ্গাস সংক্রমণ। এটি সাধারণ গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। এতে দুপাশের কুঁচকির ত্বক লাল, আঁশ আঁশ হয়ে ফুলে ওঠে। আক্রান্ত স্থান সব সময়ই চুলকায়। তবে কখনও কখনও চুলকানি এতো বেড়ে যায় যে স্থান-কাল ভুলে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কুঁচকিতে চুলকাতে দেখা যায়। এটি খুব ছোঁয়াচে রোগ। রোগীর তোয়ালে বা গামছা, স্নানাগারের মেঝে ও হোটেলের কক্ষ ও বিছানার মাধ্যমে এ জীবাণু সুস্থ মানুষকে আক্রমণ করে। অনেক সময় টিনিয়া ক্রুরিস ও টিনিয়া পেডিস একত্রে হতে দেখা যায়। এর ওপর আক্রান্ত স্থলে আবার ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। তবে পুরুষের যৌনাঙ্গ ও অন্ডথলিতে সংক্রমণ ঘটলে বুঝতে হবে যে এটি ক্যানডিডা দিয়ে হয়েছে।

আক্রান্ত স্থানে ক্রিম লাগিয়ে রোগ ভাল করা যায়। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, কুঁচকি সব সময় শুকনা রাখতে হবে এবং কোন ক্রমেই সিনথেটিকের বা কৃত্রিম সুতার অন্তর্বাস পরা চলবে না; শুধু সম্পূর্ণ সুতার কাপড় পরতে হবে।

* টিনিয়া ভার্সিকলো- দেহের যেসব জায়গার ত্বকে ঘাম নিঃসরণকারী গ্রন্থি আছে সেখানকার সংক্রমণ এটি। টিনিয়া ভার্সিকলোর ছোঁয়াচে নয়। পিঠ, কাঁধ ও বুকের ত্বকে এটি সবচেয়ে বেশি সময় হতে দেখা যায়। যে স্থানের ত্বকে এ রোগ হবে তা আশপাশের অন্যান্য অংশের ত্বক হতে গাঢ় বা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা বা অধিক আর্দ্রতা এ রোগ বিস্তারে সহায়তা করে থাকে। শুরুতে রোগীর দেহে কিছু এলোমেলো ছোট দাগের মতো দেখা যায়। এর ওপর ছোট ছোট ধুলাবালির মতো বিভিন্ন রঙের আঁশ থাকতে পারে। দেহের যে অংশে কম রোদ লাগে সে রকম সাদা ত্বকে এ দাগগুলো বেশ গাঢ় হয়। আর উন্মুক্ত গাঢ় বা কালো ত্বকে এ দাগগুলো ফ্যাকাসে রংয়ের হয়।

এ রোগে সেলেনিয়াম সালফাইড ২৫% বেশ কাজ করে। তবে কোনো কোনো সময় মুখে খাবার ওষুধও প্রয়োজন হতে পারে। এতে এ রোগের পুনঃসংক্রমণের হার কমে যায়।

* টিনিয়া ক্যাপিটিস- শিশুদের প্রধান ফাঙ্গাস অসুখ এটি। শিশুর বয়স ৩ থেকে ৭ বছরের মাঝে এ রোগ বেশি হয়। শুরুর দিকে আক্রান্ত ত্বক সমতল ও আঁশযুক্ত থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে ছোলে ওঠে। দিন যত যায় চুলকানি তত বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে চুল ভাঙতে থাকে ও উঠে যায়। টিনিয়া ক্যাপিটি যে কানের পেছনের দিকের ও ঘাড়ের পেছন দিককার নাসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলে ওঠে। দীর্ঘদিনের টিনিয়া ক্যাপিটিস সংক্রমণে মাথায় আক্রান্ত অংশে স্থায়ী চুলহীনতা (টাক) দেখা দিতে পারে। এ রোগে মুখে খাবার ওষুধ খুব জরুরি।

এ সংক্রমণে ফাঙ্গাসগুলো চুলের বেড়ে ওঠার অংশে যুক্ত থাকে বলে স্থানীয়ভাবে অ্যান্টি ফাঙ্গাস ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

ফাঙ্গাস সংক্রমণগুলোর বেশিরভাগ খুব ছোঁয়াচে বলে পরিবারের কোনো এক সদস্যের এ রোগ হলে অন্যদের সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বিশেষ করে কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র, বসার আসন ইত্যাদি ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসক দেখাতে হবে। আর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিশেষ যত্নবান হবেন। সর্বদা সুতার কাপড় পরিধান করবেন।

য় সুস্বাস্থ্য ডেস্ক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<68176 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1