ডায়াবেটিস একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যু ও শারীরিক অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ হলো ডায়াবেটিস। নারী, পুরুষ, শিশু নিবিের্শষে সবারই ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিয়ন্ত্রিত না হলে নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত এ রোগটি মানুষের কমর্ক্ষমতা হরণের পাশাপাশি চোখ, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, কিডনি, ত্বকসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। এসব সাধারণ সমস্যার পাশাপাশি ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীরা ভোগেন আরো কিছু জটিলতায়।
ডায়াবেটিস রোগের পরিণতি ও নিয়ন্ত্রণে যে কঠোর নিয়ম-কানুন পালন করতে হয় তাতে ডায়াবেটিস হয়েছে শুনলে সাধারণ মানুষের ভয় পেয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। যেমনটি হয়েছিল ৪২ বছরের সামিয়ার ক্ষেত্রে। রক্তের রিপোটর্ দেখে ডাক্তার যখন জানালেন, সামিয়ার রক্তে অতিরিক্ত শকর্রা ধরা পড়েছে অঁাতকে ওঠেন তিনি। ১২ ও ৭ বছরের দুটি সন্তান রয়েছে তার। দুজনের গভর্কালেই সামিয়ার ধরা পড়েছিল গভর্কালীন ডায়াবেটিস। ডাক্তারি মতে সন্তান জন্মদানের পর ডায়াবেটিস সেরে গেলেও গভর্কালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তদের পরবতীের্ত এ রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া সামিয়ার বাবারও ডায়াবেটিস রয়েছে। সুতরাং তার ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে বেশি এবং শেষ পযর্ন্ত ধরাই পড়ল।
রক্তে যখন গøুকোজের পরিমাণ প্রতিনিয়ত একটি নিদির্ষ্ট মাত্রার বেশি থাকে সে অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। খাবার গ্রহণের পর তা গøুকোজে পরিণত হয়ে মানুষের দেহকোষে গিয়ে শক্তি তৈরি করে। আর গøুকোজ দেহকোষে পেঁৗছে দেয়ার কাজটি করে ইনসুলিন নামক একটি হরমোন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর অগ্ন্যাশয় কম ইনসুলিন তৈরি করে বিধায় রক্তের গøুকোজ পূণর্ভাবে দেহকোষে পেঁৗছাতে পারে না। প্রধানত মানুষের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অপযার্প্ত শারীরিক পরিশ্রম, পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে এ রোগ হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রচুর প্রচÐ পিপসাবোধ করা, ঘন ঘন ক্ষুধা অনুভব করা, সব সময় দুবর্ল অনুভব করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষত সহজে না সারা ইত্যাদি। ডায়াবেটিস তিন প্রকার : টাইপ-১ ডায়াবেটিস, যাতে অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলো মরে যাওয়ায় কোনো ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না। এটি সাধারণত শিশু এবং প্রাপ্তবয়সীদের হলেও যে কোনো বয়সেই হতে পারে। চিকিৎসার জন্য ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি হয় না অথবা ইনসুলিনের কাযর্কারিতা থাকে না। ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের বিশেষ করে অতিরিক্ত ওজনের ও কম শারীরিক পরিশ্রমকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। শেষেরটি হলো গভর্কালীন ডায়াবেটিস যা ২ থেকে ৫ শতাংশ গভর্বতী নারীর ক্ষেত্রে হতে পারে। যেসব নারীর ডায়াবেটিস থাকা সত্তে¡ও আগে ধরা পড়েনি, মাতৃকালীন অবস্থায় ধরা পড়ে।
গভর্ধারণের চিন্তা করার প্রথম থেকে নিয়মিত রক্তের গøুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। শহীদ সোহরাওয়াদীর্ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, গভার্বস্থায় ডায়াবেটিস হলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই বিভিন্ন ক্ষতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে গভর্বতী মায়ের হৃদরোগ ও অন্যান্য জটিলতায় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যায়। মায়ের পাশাপাশি গভর্স্থ শিশুও এ অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত গভর্বতী মায়ের যে কোনো সময় বাচ্চা প্রসব হয়ে যেতে পারে অথবা সহসা মায়ের পেটে বাচ্চার মৃত্যু ঘটতে পারে। তা ছাড়া কোনো কোনো বাচ্চার ওজন অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়; কারো বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা হৃৎপিÐ ঠিকমতো গঠিত হয় না; ঠেঁাটকাটা, উপরের তালু কাটাসহ বিবিধ সমস্যা দেখা যায়। এসব শিশু পরবতীর্ সময়ে দৈহিক স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন রকম স্নায়ুরোগে ভোগে।
এসব অসুবিধা দূর করার জন্য নারীদের হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দেয়া হয় যা অস্থিক্ষয় ও প্রজননতন্ত্রের প্রদাহের আশঙ্কা কমিয়ে হট ফ্লাশের প্রবণতা হ্রাস করে। কিন্তু পাশাপাশি এ ধরনের চিকিৎসা স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই যদি হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নিতেই হয় তবে তা যতটুকু সম্ভব তত কম পরিমাণে নিতে হবে, প্রতি ৬ মাস অন্তর চেকআপ করাতে হবে।
খাবার নিবার্চন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, কমর্ময় ও গতিশীল জীবনযাপন প্রয়োজনে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সুস্থ থাকুন। যদিও পুরো ব্যাপারটি কষ্টদায়ক কিন্তু আখেরে আপনি থাকবেন সুস্থ ও দুশ্চিন্তামুক্ত। ফলে আপনি পাবেন অধিক শক্তি, অন্যান্য রোগবালাই থেকে সহজে মুক্তি, কম ক্লান্তি, কম পিপাসা, ত্বক বা বøাডারের কম প্রদাহ। এর সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাবে হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি, চোখের সমস্যা, স্নায়ুর ক্ষয়, কিডনির সমস্যা, দঁাত ও মাড়ির সমস্যা। সদা প্রফুল্ল রাখবে আপনাকে। মনে রাখবেন, মহিলাদের বিষণœতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় উপায় হঁাটা। শুধু ডায়াবেটিস নয়, বরং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকরা সপ্তাহের অন্তত পঁাচ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে হঁাটার পরামশর্ দেন। সে ক্ষেত্রে আপনি কোন গতিতে কতক্ষণ হঁাটবেন তা অবশ্যই আপনার চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন। নিয়মিত হঁাটার পাশাপাশি ঘরের বিভিন্ন কাজকমর্, বাগান করা, ধারেকাছে হেঁটে যাতায়াত করা, বাড়িতে-অফিসে লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি অভ্যাস পারে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে। এ ক্ষেত্রে নারীদের যে সমস্যা তা হলো তারা সংসারের সবার জন্য কাজ করেন, সবার খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, পড়াশোনা, চিকিৎসা, সেবা ইত্যাদি সবই করেন; কিন্তু তাদের সেবার বেলায় দেখা যায় কাউকে পাওয়া যায় না। তাই নিজের প্রয়োজনে মা, মেয়ে, বোন, নানি, দাদি যে-ই হোন না কেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনার নিজের উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।