শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমানী তিরু

নুসরাত রীপা
  ২৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সারাদিন বৃষ্টি। একদম ভালো লাগছে না তিরুর।

মাম্মাম ওকে কোলে নিয়ে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে দেয়। তারপর টিভি অন করে ইউটিউবে টম অ্যান্ড জেরি ছেড়ে দিয়ে কড়া গলায় বলে, তিরু, চুপচাপ বসে টিভি দেখো। একদম নড়বে না। যদি কথা না শোনো দুপুরে কিন্তু ইলিশ মাছ দেবো না। যদিও চিকেনটাই তিরুর সবচেয়ে প্রিয় তবে ইলিশ খেতেও তার খুবই ভালো লাগে। ইলিশের নাম শুনে জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একটু চেটে চুপচাপ টিভি দেখতে থাকে।

টম অ্যান্ড জেরি ওর খুবই পছন্দের টিভি শো। কিন্তু টমের ওপর প্রায় সময়ই ভীষণ রাগ হয়। বিশেষ করে জেরির কাছে যখন টম বারবার নাস্তানাবুদ হতে থাকে তখন তিরুর ইচ্ছে করে টিভির ভেতর থেকে একটানে টমকে বের করে এনে নিজেই ওখানে গিয়ে জেরিকে ইচ্ছেমতো পিটুনি দিয়ে আসতে! কিন্তু টিভির ভেতরে ঢোকার দরজাটা এখনো খুঁজে পায়নি তিরু! টুপ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল হঠাৎ। সোফা থেকে নেমে হাত-পায়ের খিলটা একটু ছুটিয়ে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসার ঘর থেকে বের হয়ে এলো তিরু। পুরো বাসা সুনসান। বাবা অফিসে, টুনি আর রুনি স্কুলে। মাম্মাম রান্না ঘরে।

চোখে পড়ল দরজার পর্দার কাছে একটা বাচ্চা টিকটিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাটাকে একটু ভয় দেখানো দরকার ভাবল। যেই ভাবা সেই কাজ। দরজার পাশের আলমিরা বেয়ে পর্দার স্ট্যান্ডে উঠে পড়ল। টিকটিকিটাকে ধরার জন্য দেয়ালে থাবা বসাতেই টিকটিকিটা সুড়ুত করে সরে যায়। তিরু থাবা তুলে নেয়। টিকটিকিটা আবার এগিয়ে আসে। তিরু দেখে পর্দার স্ট্যান্ডের কাছে একটা মাকড়শা। নিজের পলকা জালে জবুথবু মেরে বসে আছে। টিকটিকিটা সন্দিহান দৃষ্টিতে তিরুকে বুঝে নিতে চায়। সত্যি বলছে না মিথ্যে। তারপর কী মনে করে মাকড়শাটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসে। তিরু থাবা মারার জন্য হাত তুলতেই সেটা এক দৌড়ে লাইটের পেছনে লুকিয়ে গেল।

কী আর করা! বেশ একটু সময় অপেক্ষা করে তিরু অগত্যা নিচেই নেমে এলো। নামার সময় আলমিরার ওপর রাখা ছোট একটা বাক্স ওর পায়ে লেগে ঝুপ করে পড়ে গেল। আর ওর থেকে সুগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

তিরু বুঝল ও সেন্টের শিশি ভেঙে ফেলেছে। হায় হায়। মাম্মাম ওকে এখানে দেখলে খবর আছে। তাড়াতাড়ি মাম্মামের রুম থেকে সতর্ক পায়ে বের হয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ায়। আর তখুনি চোখ যায় অ্যাকিউরিয়ামটার দিকে। জিনিসটা মাত্র কয়দিন হয় বাসায় আনা হয়েছে। লতা-গুল্ম, শামুখ-ঝিনুক আর নুড়ি পাথরে সাজানো কাঁচের বাক্সটার প্রতি প্রথম দিন থেকেই ভীষণ কৌতূহল তিরুর। ও শুনেছে ওই কাচের বাক্সটার নাম অ্যাকিউরিয়াম। আর ওটা আসার পর থেকে বাসার সবার আগ্রহ ওতেই বেশি। রুনি টুনি আগে স্কুল থেকে ফিরেই তিরুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, তিরুকে কিছুক্ষণ দেখতে না পেলেই অস্থির হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করত। আর এখন? ভাবতেই তিরুর মন খারাপ হয়ে যায়! ওই কাচের অ্যাকিউরিয়ামটা আসার পর রুনি, টুনি ওটা নিয়েই ব্যস্ত। তিরুকে ওর কাছে যেতে দেখলেই হা হা করে ওঠে বাসার সবাই।

চারদিকে নজর বুলিয়ে তিরু ভাবল এখনিই উপযুক্ত সময় ওই কাচের বাক্সটায় কী আছে সেটা দেখে নেয়ার। লম্বা পা ফেলে অ্যাকিউরিয়ামের দিকে এগোলো।

ড্রইং রুম আর ডাইনিং রুমের মাঝামাঝি বুকর্ যাকটার পাশে অ্যাকিউরিয়াম রাখা।র্ যাকের তাকে তাকে লাফিয়ে অ্যাকিউরিয়াম পর্যন্ত উঠে যেতে মোটেই কষ্ট হলো না তিরুর। তারপর যা দেখল তাতে তো চক্ষু চড়কগাছ। বাহ্‌ বাহ্‌ কী সুন্দর লাল, নীল, সোনালি মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে! মাছগুলো দেখে লোভ সামলানো দায় হয়ে পড়ছে। কতক্ষণ আর চোখের সামনে এভাবে জ্যান্ত মাছের ঘুরে বেড়ানো দেখা যায়! অনেক কসরত করে একটা মাছ ধরে ফেলল তিরু। মুখে চালান দিতে যাবে সে সময়ই টুনি রুনির বাড়ি ফেরার সাড়া-শব্দ কানে এলো। টুপ করে মাছটা জলে ফেলে খাবার টেবিলের নিচে গিয়ে একটা তুলোর বলের মতো গোল হয়ে শুয়ে পড়ল তিরু। লম্বা একটা হাই তুলে চোখ বুজল।

রুনি, টুনি ঘরে ঢুকেই মাছগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিরুকে ডাকল না আগের মতো। টেবিলের নিচে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আপনমনে রান্নাঘরের দিকে এগোলো তিরু। রান্নাঘরে কেউ নেই, ফাঁকা। একটা বাটিতে অনেক কটা ভাজা মাছ রাখা আছে। তিরু ওখান থেকে একটা মাছ আস্তে করে তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে ঘর থেকে বেরোতে যাবে অমনি কাজের বুয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। হায় হায়রে মরার বেলাই? তুই আবার মাছ নিয়া গেলি।

বুয়ার চেঁচামেচি আর মায়ের সাড়া পেয়েই দ্রম্নত সেখান থেকে কেটে পড়ল তিরু। ও বুঝতেই পারে না একটা মাছ খেলে কী হয়! আর এখন তো কিনতেও হবে না। ওই কাচের বাক্সে ওরা মাছ পালছে যে! এরই মধ্যে রুনির কণ্ঠ শোনা যায়। মায়ের সেন্টের বোতল ভাঙা। কে ভেঙেছে! তারপর শোনা যায় বুয়ার কণ্ঠ, বিড়ালটা মাছ খেয়ে গেছে!

সবাই বলছে, সব দোষ তিরুর। তিরু দিন দিন ভীষণ দুষ্টু হয়ে উঠছে। কথা শোনে না। গত পরশু পাশের বাড়ির পোষা পায়রাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল- বলল মা।

মায়ের কথা শুনে তিরুর চোখে জল চলে এলো। মোটেও সে পায়রা শিকার করতে যায়নি। একা একা ভালস্নাগছিল না। রুনি টুনি তো মাছ নিয়ে ব্যস্ত! তিরু তাই পায়রাটার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ছিঁচকাঁদুনে পায়রাটা চিৎকার করে কী বিচ্ছিরি অবস্থা করল। পরে প্রাণ বাঁচাতে তিরুকে কী কষ্টটাই না করতে হলো! অথচ সবাই তিরুকে ভুল বুঝল!

তিরু ঠিক করল, এ বাসাতে ও আর থাকবেই না। চলে যাবে। অনেক দূরে---!

যেই ভাবা সেই কাজ। তিরু বাসার গেট দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। বিশাল রাজপথ, শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তিরুর গা ভিজে যাচ্ছে। তিরু অচেনা পথে একা হাঁটছে। এভাবে একা কোনোদিন বাড়ির বাইরে আসেনি তিরু। হাঁটতে বেশ একটু ভয় ভয় করছে। কোথায় যাবে? কী খাবে? দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। কিন্তু কী আর করা! যেতে তো হবেই। যেখানে কেউ ভালোবাসে না সেখানে থেকে কী হবে! দীর্ঘশ্বাস বেরোয় কষ্টে। আশপাশে তাকিয়ে কোথায় একটু আশ্রয় নেয়া যায় ভাবতে থাকে তিরু। এই বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে!

ঠিক সেই সময়ই ক্র্যাক করে একটা গাড়ি এসে থামল তিরুর পাশে। অবাক হয়ে তিরু দেখল ওই গাড়ি থেকে বাবা নামছে। তিরু দৌড়ে পালাবে ভাবতে ভাবতেই বাবা ঝুঁকে তিরুকে কোলে তুলে নিল। ইস তিরু সোনামণিটা তুমি এই বৃষ্টিতে বাইরে এলে কীভাবে? বলতে বলতে বাবা গাড়িতে উঠে টিসু্য দিয়ে তিরুর গা মুছতে লাগল!

ইস্‌ কেন যে গলার বেল্টটা ছিল! তা নইলে বাবা ওকে চিনতেই পারত না। এখন আবার বাসায় যেতে হবে! সবাই মাছগুলোকে আদর করবে। ওকে একা একা থাকতে হবে। অভিমানে তিরুর চোখে জল চলে এলো।

তিরুকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকেই বাবা হইহই করে উঠলেন। পোষা প্রাণীকে ছেড়ে দিলে তারা বড় অসহায় হয়ে পড়ে। ও তো ছোট থেকে শিকার করে খেতে শেখেনি। একা একা বেঁচে থাকার কৌশল শেখেনি। এখন ওকে ছেড়ে দিলে ওর তো বেঁচে থাকতে কষ্ট হবে। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে মা, টুনি, রুনি, বুয়া সবাই এগিয়ে এলো। বাবার কোলে তিরুকে দেখে সবাই বিস্মিত! বাবা তিরুকে কোথায় পেয়েছেন শুনে সবাই হা হা করে উঠল। মা বললেন, কখন বেরিয়ে গেল দেখিনি তো। আহা জলে ভিজে গেছে একদম!

বাবা বললেন, ওর দিকে লক্ষ্য রাখবে। ভালোবাসা না পেলে তো ও চলে যেতে চাইবেই। যদি ভালোবাসতে না পারো তাহলে ওকে অন্য কারও কাছে অ্যাডাপশন দিয়ে দাও---

রুনি টুনি একসঙ্গে বলে উঠল, কক্ষনো নয়। তিরুকে আমরা অনেক অনেক ভালোবাসি। ওকে নিয়ে না শুলে আমার ঘুমই আসে না-বলল রুনি। টুনি বলল, আমি অঙ্ক করার সময় ও আমার গা ঘেঁষে না বসলে আমার ফর্মুলাগুলো মনেই আসে না।

রুনি টুনি দুজনে বাবার কোল থেকে তিরুকে টেনে নিজেদের কোলে নিল। রুনি বলল, তিরু ফের যদি পালাতে চাস পিট্টি দেবো! বলেই তিরুর ঘাড়ে আদর করে দিল। টুনিও আদর দিল।

এত আদর পেয়ে তিরুর মনে হলো, এত ভালোবাসা ছেড়ে আমি আর কোথাও যাবো না।

এসময় মাম্মাম পাশ থেকে বলল, চুরি করে একটুকরো মাছ খেয়ে তো ওর পেট ভরেনি। দাঁড়াও ওর জন্য মাছ ভাত এনে দিচ্ছি। মাছ চুরির কথাটা মনে পড়তেই তিরুর ভীষণ লজ্জা লাগল। লজ্জায় ও রুনির বুকে মুখ লুকালো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<72714 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1