শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিশুতোষ গল্প

হেডমাস্টার

প্রিন্স আশরাফ
  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আদরে বাদর হয়, কথাটা আমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি খেটে গেল। কেউ আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়াতে পারল না। আব্বার বন্ধুস্থানীয় মানুষ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। আব্বা হেডস্যারের সঙ্গে যুক্তি করে নিজে গিয়ে আমাকে স্কুলের খাতায় নাম তুলে দিয়েছেন। কিন্তু গরু যদি ঘাস না খেতে চায় তাহলে মাঠে বেঁধে রেখে লাভ কি!

দুরন্তপনায় তখন আমি এক নাম্বারে। বয়স বেড়ে আট-নয় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো স্কুলের আঙিনা মাড়াইনি। বড় আপার কাছ থেকে শিখে শিখে ক্লাস টুয়ের বই শেষ করে ফেলেছি। আব্বাও স্কুলে আমাকে টুতে ভর্তি করিয়ে রেখেছে। শেষমেশ বড় আপাই বুদ্ধিটা বের করল। লোভ দেখিয়ে যদি আমাকে স্কুলে পাঠানো যায়। আমি যদি স্কুলে যাই তাহলে আমাকে প্রতিদিন চার আনা করে দেয়া হবে। তখনকার দিনের চার আনার মূল্য ছিল দশ টাকার চেয়ে বেশি। চার আনা দিয়ে শনপাপড়ি, চিট, হাওয়ার মিঠাই আরও কত কি পাওয়া যেত। আর এখনকার মতো টিফিনমানিজাতীয় কোনো শব্দই ছিল না।

চার আনার লোভে পড়ে স্কুলে যেতে শুরু করলাম। স্কুলও খুব একটা খারাপ জায়গা না। পড়াশোনার ঝামেলা না থাকলে জায়গা ভালোই। অনেক বন্ধু পাওয়া যায়, হৈহট্টগোল চেঁচামেচি করা যায়, এমনকি মাটির মেঝেতে গর্ত করে মার্বেলও খেলা যায়। আর সেই মার্বেল খেলা নিয়ে কায়দামতো ঝগড়াও করা যায়।

কিন্তু ঝামেলা বাধালো হেডস্যার। হেডস্যার আজগর আলী বেশ রাগী আর রাশভারী মানুষ। রেগে গেলে অজগর সাপের মতো একটানা ফোঁস ফোঁস করেন। বড় ক্লাসের ভাইয়েরা এজন্য হেডস্যারকে আড়ালে অজগর স্যার ডাকে। আমরা বেশি ছোট হওয়ায় ডাকতে সাহস করি না।

স্কুলে হেডমাস্টার মানেই হলো ভয় ভয় ব্যাপার। গুরুগম্ভীর, রাশভারী, থমথমে মুখ। লম্বা-চওড়া হেডস্যারকে আসতে দেখলেই আমাদের আত্মা শুকিয়ে যায়। স্যারের নাগড়া জুতোর মচমচে পরিচিত শব্দ শুনলেই আমরা একেবারে ভেজাবেড়াল হয়ে যাই। হেডস্যার অবশ্য ক্লাস টুয়ের মতো নিচু ক্লাসে কখনো পড়ান না। তবে মাঝেমধ্যে অন্য স্যারেরা কেমন পড়াচ্ছেন তা দেখতে আসেন। আর এসেই আমাদের এমন ধমক লাগান আমরা নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে ফেলি।

সেদিন বাড়ির পেয়ারাগাছে উঠে ডাসা পেয়ারা সাঁটছিলাম। হঠাৎ গাছ থেকেই দেখতে পেলাম আমাদের কাঠের গেট খুলে হেডস্যার ঢুকছেন। হাতের পেয়ারায় কামড় বসাতে ভুলে গেলাম। আধ খাওয়া পেয়ারা ফেলে দিয়ে গাছ থেকে নেমে একেবারে শান্তশিষ্ট হয়ে মায়ের আঁচলের নিচে লুকালাম। আমার কেবলই মনে হতে লাগল, হেডস্যার আমার খোঁজেই এসেছেন। এক্ষুণি আমাকে ডেকে রামধমক লাগাবেন স্কুলে দুষ্টুমি করার জন্য। হেডস্যার আব্বার সঙ্গে কি একটা বিষয় নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলেন। হঠাৎ আব্বা ডাকলেন আমাকে, 'ছোটন এদিকে আয়, দেখ কে এসেছে?'

কে এসেছে তা আমি আগেই দেখেছি। তবু আব্বার ডাকে একদম গোবেচারা ভাব ধরে হেডস্যারের সামনে গেলাম। হেডস্যার আমার নাম জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন, স্কুল কেমন লাগছে? আমি একদিকে মাথা কাত করে 'ভালো' জানালাম।

হেডস্যার যাওয়ার আগে শাসালেন, ক্লাসে সবসময় ভদ্রছেলে হয়ে থাকবে, মারপিট করবে না, কেউ মারামারি করলে আমাকে জানাবে, মনোযোগ দিয়ে পড়বে।

হেডস্যার চলে যাওয়ার পরে মা জানালেন, স্যার আব্বার কাছেই এসেছিলেন। স্যারের দরকারে। আমার খোঁজে নয়। আমি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম।

রোববার আমাদের এখানে হাটের দিন। ওইদিন হাট বসে বলে স্কুল ঠিকমতো হয় না। আব্বার ওষুধের দোকানে হেল্প করতে হয় বলে আমি স্কুলে যাই না। অন্যান্য মাস্টাররাও নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এত প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল খোলা বা বন্ধ হওয়ায় তেমন আসে-যায় না। কেউ খোঁজ-খবর করে না।

দুপুর পর্যন্ত দোকানে আব্বার সঙ্গে ওষুধ সাপস্নাই দিয়ে কাটালাম। তারপর আব্বা আমাদের ট্রান্সজিস্টার রেডিওটা বের করে আমার হাতে দিলেন। একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললেন, হাটের একেবারে শেষ মাথায় রেডিও সারাইয়ের দোকান বসে। গিয়ে রেডিওটা সারাই করে আন। সেন্টারগুলো ঠিকঠাকভাবে দেখে আনবি। বিবিসি যাতে ঠিকমতো শোনা যায়। আর পাঁচ টাকা দিয়ে আমার কথা বললেই হবে। এই ন'বছর বয়সেই বাজার ঘুরে ঘুরে আমি পাক্কা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছি। আব্বা পাঁচ টাকা দিয়েছে, আমি দরদাম করে চার টাকায় রাজি করাতে পারব। এক টাকা আমার নিট লাভ থাকবে। কাজেই আগেই লাভের টাকার সদ্ব্যবহার করলাম। কুলফি মালাই, হজমি গুলি, লজেন্স এসব কিনে মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দিলাম।

হাটের শেষ মাথায় রেডিও সারাইয়ের দোকানটা খুঁজে পেলাম। একজন লোক নিচের দিকে ঘাড় গুঁজে এক চোখের মধ্যে ছোট্ট কাচের বাটির মতো কি যেন লাগিয়ে রেডিও সারাই করছে। আমি রেডিওটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, রেডিওটা ঠিক করে দেন? একটু দরদাম করার জন্য বললাম, কত লাগবে?

রেডিওর মিস্ত্রী রেডিওটা হাতে নিয়েই আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। এক চোখে লেন্স লাগিয়ে বন্ধ থাকার পরেও আমি মানুষটিকে চিনতে পারলাম।

হেডস্যার!

আমি তখন দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু হেডস্যারও আমাকে চিনে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, খুব নরমস্বরে বললেন, তোর আব্বা কত দিয়েছে? দে। বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

আমি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আব্বা পাঁচ টাকা দিয়েছে। কিন্তু এখন আছে চার টাকা। হেডস্যার যদি আব্বাকে বলে দেয়। আমি চারটাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, স্যার, আব্বা পাঁচ টাকা দিয়েছিল। এক টাকা খরচ হয়ে গেছে।

হেডস্যার হাসিমুখেই চার টাকাই নিলেন। তারপরে যেন একেবারে বন্ধুর মতো স্বরে কৈফিয়তের স্বরেই বললেন, হাতের কাজটা সেরে নিই। তারপর তোদেরটা ঠিক করে দিচ্ছি। এখানে ভিতরে আমার পাশে এসে বস। আমি বাধ্য ছাত্রের মতো স্যারের পাশের একটা টুলে বসলাম। স্যার এক চোখে সেই লেন্সটা লাগিয়ে রেডিওর ওপর ঝুঁকে পড়ে তাঁতাল দিয়ে ঝালাই করতে করতে বলল, আমাকে এখানে দেখে অবাক হয়েছিস, না? অনেকেই অবাক হয়। অবাক হতে হতে মানুষের চোখ সওয়া হয়ে যাবে। আমি তো তাও ভদ্রগোছের একটা কাজ করি। হাতের কাজ। ছাত্রজীবনে শিখেছিলাম। এখন কাজে লাগছে। স্কুলের অনেক মাস্টার অন্য কাজও করে। তোদের সুধীর স্যার একজনকে সঙ্গে রেখে বাজারে মসলার ব্যবসা করে। গরম মসলা। কি আর করবে? স্কুলে যে বেতন হয় তাতে কারোরই যে সংসার চলে না। কোনো মাসে বেতন হয়, কোনো মাসে হয় না। কিন্তু আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। তোদের পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে গেলে আমাদের পেটে তো কিছু থাকতে হবে। তুই ছোট মানুষ, এসব কথা বুঝবিনে। বড় হলে বুঝবি।

রেডিও নিয়ে চলে আসার সময় হেডস্যার আমার হাতে জোর করে চার আনা ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধের সুরে বললেন, শোন, তোদের ক্লাসের সবাইকে বলবি, বাড়িতে গিয়ে যেন বলে হেডস্যার হাটবারে রেডিও সারাই করে। সবাইকে বলবি, বুঝেছিস। সবাই জানলে আমার কাস্টমার বাড়বে।

ওই ঘটনার পর থেকে গুরুগম্ভীর রাগী থমথমে মুখের হেডস্যারকে আমার আর দশটা সাধারণ কাছের মানুষের মতো মনে হতে থাকে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<65655 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1