শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শিশুতোষ গল্প

ক্রিং... ক্রি...

শান্তা ফারজানা
  ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

সারাদিনের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে কাদা মুড়িয়ে আছে রাস্তায়। কোথাও কোথাও জমে উঠেছে পানিও। কাদাপানি ঠেলেই ভ্যান টানছে শাহীন। ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালাতে কষ্ট কম। কিন্তু তার বয়স আর শারীরিক অবস্থা অনুপাতে ভ্যান চালাতে বেশ কষ্ট হয়। আজ কষ্টটা আরও বেশি হচ্ছে। ভ্যানের চাকা পড়ছে কখনো কাদার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা গর্তে, কিংবা কখনো আটকে যাচ্ছে আঠালো এঁটেল মাটিতে। বারো কি তেরো বছরের শাহীন হাঁপিয়ে উঠছে থেকে। গুঁড়ি গুঁড়ি বর্ষণে ভিজে গেছে গায়ের গেঞ্জি, প্যান্ট। তবে মাথাটা ঢেকে রেখেছে সফেদ পলিথিনে।

- কি রে? জোরে টান। গায়ে শক্তি নেই?

- খাস না? এমনে গেলে তো রাইত হইয়া যাইবো গা।

- এমুন বৃষ্টিতে আর গাড়ি পাই নাই। নাইলে অর ভ্যানে উডি? এমুন ছোড ড্রেইভারের গাড়িত উডা ঠিক না।

নানা জনে নানা কথা বলে। কেউ বয়স নিয়ে, কেউ গায়ের শক্তি নিয়ে। কেউবা আবার কটুবাক্যও ছুড়ে মারে কখনো কখনো। শাহীন কারও কথা বা উপহাসই গায়ে মাখে না, কানেও তোলে না। সে তার মতো চালিয়ে যায় তিন চাকা। ঘরে মা, ছোট বোন আর অসুস্থ বাবা। তিনজন মানুষের ছয়টি চোখ তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। দিনশেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে যা উঠিয়ে দেয় তাই কেটেকুটে চুলায় চড়িয়ে দেয় মা। বাবা যক্ষ্ণা রোগের রোগী। তিনিও রিকশা চালাতেন। কিন্তু এখন আর পারেন না, উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তিনি এখন মৃতু্যর পথযাত্রী প্রায়। তাই শাহীন কিছু টাকা জোগাড় করে কিস্তিতে এই ভ্যানগাড়িটার ব্যবস্থা করেছে শাহীন। রোজ যা আয় করে তা থেকে সংসারের খরচের ব্যবস্থা করে এবং অল্প করে জমিয়ে রাখে সপ্তাহ শেষে কিস্তির পরিশোধের জন্য।

ক্রিং... ক্রিং...

কাদাপানি উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলে শাহীন। তাকে এগিয়ে যেতে হবেই। বুদ্ধি-জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মাকে একবেলা খেতে দেখেছে। মা কখনোই তিনবেলা তো দূরে থাক, দুবেলাও ঠিকমতো খেতেন না। একবেলা খেয়ে বাকি ভাত পানি দিয়ে তুলে রাখতেন। শাহীন দেখত কেবল। বলতে পারত না। জানে যে মা তার কথা আদরে হেসে উড়িয়ে দেবেন। ছোট বোনটা স্থানীয় সরকারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বোনটা যেন পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারে সে জন্য তার খাতা-কলম টিফিনের টাকা সবসময় ব্যবস্থা করে রাখে শাহীন। শাহীন স্বপ্ন দেখে, ছোট্ট একটা পাকা ঘরের যে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়বে না। মাকেও আর বালতি নিয়ে শতছিন্ন চালা দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি আটকাতে ছুটতে হবে না। বাবার বিছানার বালিশের কাছাকাছি জায়গায় চালের মধ্যে একটু ভাঙা আছে। একটু জোর বর্ষণেই ঝেপে পড়ে পানি। মা এসে বাবার বালিশের কাছে একটা মাটির শানকি রেখে যান। চাল থেকে ঝরে পড়া পানি মাটির শানকিতে পড়ে পড়ে ছিটিয়ে আসে বাবার মুখেও। বাবার কাশিটা তখন আরও বেড়ে যায়। তার খুশ খুশ কাশির শব্দটা দামামার মতো বাজতে থাকে শাহীনের মাথায়। তার মনে হয় এই কাশি বাবার যক্ষ্ণার নয়, ব্যর্থতার কাশি।

- এই রিকশা, জোড়াই বাজার যাইবা? কত নিবা?

- পঞ্চাশ ট্যাহা।

- কী কস না কস?? ব্যাডা, ঐতো দেখা যায় বাজারডা! এত্তো চাস ক্যান!

- ভাই, আপনার লগের মালপত্তরও তো টানা লাগবে, নাহি?

- হঁ্যা, তো কী অইছে? এইগুলান কত কিলো বল দেকি?

এভাবে তর্ক-বিতর্ক করে ভ্যানে ওঠে লোকটা। সঙ্গে কয়েকটা পস্নাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো জিনিসপত্র। কয়েক কিলো রাস্তা জোড়াই বাজার। তবুও শাহীন চলিস্নশ টাকায় রাজি হয়। কেননা, বসে থাকার চেয়ে ভ্যান চালিয়ে সময়টা কাজে লাগানো ভালো। যা আসে তাই লাভ। কষ্ট করেই তো খেতে হবে, বসে থেকে লাভ কী? কত পদের মানুষ যাতায়াত করে তার ভ্যানে। কেউ ভালো কথা বলে, কেউ উপদেশ দেয় লেখাপড়া করার, কেউ আবার বেশি বেশি খাওয়ার কথা বলে, কেউ বা আবার কোনো কথাও বলে না, মুখের দিকেও তাকায় না; নির্দিষ্ট ভাড়ার পাঁচ টাকা বেশি দিয়ে নিভৃতে চলে যায়। যারা তার অপরিপক্ব বয়স নিয়ে বিড় বিড় করে, তাদের খুব বলতে ইচ্ছা করে তাকে ভরণ-পোষণের টাকা দিতে। সংসারের খরচ দিতে। শাহীন তার চাকার নিচে জমে থাকা কাদাপানির দিকে তাকায়। সেখানে নিজের ঢেউ ওঠা অবয়ব। সেও তো পড়ালেখা করার স্বপ্ন দেখেছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনীর প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও আর পরীক্ষা দিতে পারল না। সবাই যখন সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এ পস্নাস, এ গ্রেড নিয়ে পাস করার ইচ্ছায় পড়াশোনা করত, সে তখন বেল বাজিয়ে বের হতো ভ্যান নিয়ে।

- শাহীন, অই শাহীন।

\হগায়ে জ্বর নিয়ে শুয়ে ছিল ভ্যানচালক শাহীন।

-কিডা?

- আমরা, বাক্কারশাহ মসজিদে যামু। শাহীনের মায়ের প্রশ্নে জবাব দিল মধ্যবয়সী কেউ। আমরা তিনজন। ভালা ট্যাকা দিমুনে।

শাহীন গেঞ্জির ওপর পাতলা চাদর পরেই বেরিয়ে এলো। কিছু টাকা বেশি পেলে ক্ষতি কী? মুখে পানির ঝাপটা দিয়েই উঠে বসলো ভ্যানে। তিনটা লোককে নিয়ে টানতে শুরু করল ভ্যান। শুকনো কাদার ওপর দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে। কাদা শুকিয়ে এখন চালানোটা আরেকটু কঠিন। কারণ, চাকা আটকে যায়। জ্বরের গায়েও ঘেমে ওঠে শাহীন। তবুও যে স্বপ্ন সে দেখে, সেই স্বপ্ন তাকে বসে থাকতে দেয় না। কিশোর বয়সের কষ্ট বৃথা যাবে না কোনো দিনও।

চারদিকে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে। যেন ঝুপ করেই চাদর ফেলে দিয়েছে সন্ধ্যাটা। হঠাৎ তিনজনের কেউ একজন পেছন থেকেই চেপে ধরে শাহীনের মুখ। জোরে ব্রেক কষে ছেলেটা। বাকি দুজনে মিলে তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চায় ভ্যানের সিট থেকে। কিন্তু হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে থাকে শাহীন। সে বুঝতে পারে, লোকগুলো ছিনিয়ে নিতে চায় তার ভ্যানটা।

- ভাইজান, আমার ভ্যানটা নিয়েন না, ভাইজান। না খাইয়া মইরা যামু।

- চোপ, শালার পুত। পাও ছাড়।

- ভাই, আমার বাপ অসুস্থ। মা-বোনরে নিয়া মইরা যামু। মাফ কইরা দ্যান, ছাইড়া দ্যান।

- ছাড়। ছাড় কইলাম। শাহীনের আকুতিতে গলে না পাষন্ডদের অন্তর। তারা লোক জড়ো হয়ে যাওয়ার ভয়ে হঠাৎই কোপ মেরে বসে শাহীনের মাথায়। তারপর ধমাধম মেরে বসে আরও কয়েকটা কোপ।

তারপর নিস্তেজ নিস্তব্ধ ছেলেটাকে পেছনে রেখে পালিয়ে যায় ভ্যানটা নিয়ে।

রক্তাক্ত শাহীন পড়ে থাকে পথে। কোপের আঘাতে কাটা মাথা থেকে বেয়ে পড়া রক্তে ভিজে যায় তার সোনালি স্বপ্ন। সে কেবল শুনতে পায় তার প্রাণের শব্দ ক্রিং...ক্রিং

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<63584 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1