শ্রাবণ মাস। দুপুরবেলা। বৃষ্টি পড়ছে। ঝমঝমিয়ে। শুক্রবার। অফিস বন্ধ। ইশকুল বন্ধ। সবার ছুটির দিন। মায়ের ছুটির দিন। বাবার ছুটির দিন। সারার ছুটির দিন। অলস দুপুর। মা-বাবা ঘুমাচ্ছে। সারাও শুয়েছিল। মা তাকে টেনে নিয়ে শুয়ে দিয়েছিল। জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আজ তো ছুটির দিন। একটু শুয়ে ঘুমাও। দুপুরের ঘুম শরীরের জন্য ভালো। সারা ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে মায়ের পাশে চুপ করে শুয়ে রইল। কিন্তু ঘুম এলো না। একটু পর আবার চোখ খুলল। তাকাল মায়ের দিকে। মা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকাল বাবার দিকে। বাবাও ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আস্তে করে বিছানা ছেড়ে উঠল। পা টিপে টিপে পড়ার টেবিলের কাছে গেল। ভাবল, কী করি এখন? বই পড়ি। গল্পের বই।
পরক্ষণে ভাবল, না, বই পড়া যাবে না। মা-বাবা ঘুমাচ্ছে। বই পড়লে তাদের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে।
তাহলে কী করি? গালে তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বিজ্ঞের মতো ভাবে সে। একটু ভেবেই লাফিয়ে ওঠে, ইউরেকা। পেয়েছি। এখন ছবি আঁকব।
সে ড্রয়িং খাতা আর রং-পেনসিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে পড়ল। হিজিবিজি আঁকতে আঁকতে আস্ত একটা বাঘ এঁকে ফেলল। ডোরাকাটা বাঘ। বাঘের ইয়া লম্বা একটা লেজ! লেজ তো নয়, যেন হাতির শুঁড়! বাঘ এঁকে সে রান্নাঘরে গেল। একগস্নাস ঠান্ডা পানি খেল। ফিরে এসে আবার ড্রয়িং খাতা নিয়ে বসল। বাঘের তো ছবি আঁকলাম। এবার একটা জঙ্গলের ছবি আঁকতে হবে। জঙ্গল না থাকলে বাঘ থাকবে কোথায়?
জঙ্গল আঁকার জন্য সে ড্রয়িং খাতা হাতে নিল। খাতা হাতে নিয়েই অবাক হলো। সে যে বাঘটা খাতায় এঁকেছিল, নেই! পড়ে আছে ড্রয়িংয়ের সাদা পাতা।
মা কী ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং পাতাটা ছিঁড়ে লুকিয়ে রাখল? ভাবল সে। তাকাল মায়ের দিকে। উঁহু। মা তো এখনো ঘুমাচ্ছে।
তাহলে কী বাবা লুকিয়ে রাখল?
তাকাল বাবার দিকে। বাবাও ঘুমাচ্ছে। তাহলে কে নিল তার বাঘ? ভাবে সারা। তখনই বাঘটা এসে তার লম্বা লেজ দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে লাগল।
সারা চমকে উঠে তাকাল পিছনে। আস্ত একটা বাঘ তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! বাঘ দেখে মোটেই চমকালো না সে। ভয়ও পেল না। বলল, বাঘ মামা, তুমি কোথা থেকে এলে রে?
বাঘ হেসে বলল, কেন? তোমার খাতা থেকে।
ইহহ! খাতা থেকে বের হওয়া যায় নাকি?
যায় তো।
উঁহু। যায় না।
যায়।
ইহহ! হাতে আঁকা বাঘ কখনো হাঁটতে পারে না।
এই তো আমি হাঁটছি।
তুমি আমার আঁকা বাঘ নয়।
আমিই তোমার আঁকা বাঘ।
বললেই হলো? হাতে আঁকা বাঘ কখনো খাতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। হাঁটতে পারে না।
পারে। আমি পারি।
ইহহ্!
বিশ্বাস হচ্ছে না।
নাহ। একদম না।
ভালো করে দেখো, আমিই তোমার আঁকা বাঘ। পেটে তোমার আঁকা ডোরাকাটা দাগ। বাঁকা বাঁকা চোখ। বোঁচা নাক। হাতির শুঁড়ের মতো লম্বা একটা লেজ।
সারা দেখল সত্যিই তো! এটা তো তারই আঁকা বাঘ! বাঘের পেটে ডোরাকাটা দাগ। চোখ বাঁকা। নাক বোঁচা। লম্বা লেজ। সারা অবাক হয়ে বলল, তুমি খাতা থেকে কীভাবে বের হয়ে এলে রে বাঘ?
বাঘ বলল, আমি হলাম বনের রাজা। আমাকে কেউ খাতায় আঁকলে আমি ইচ্ছে করলে খাতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। তারপর বলল, চলো সারা, তোমাকে আজ আমার রাজ্যের বন, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত, নদী দেখাব।
নাহ। যাবো না।
কেন?
মা-বাবা বোকা দেবে।
মা-বাবা টের পাবে না। তারা তো ঘুমাচ্ছে।
যদি ঘুম ভেঙে যায়?
ভাঙবে না। তাদের ঘুম ভাঙার আগেই আমরা ফিরে আসব।
ঠিক তো?
ঠিক।
তাহলে চলো।
উঠে বসো আমার পিঠে।
সারা বাঘের পিঠে উঠে বসল। বাঘ ছুটে চলল দুরন্ত গতিতে। একের পর এক বন, জঙ্গল, পাহাড়, নদী আর পর্বত পেরিয়ে যেতে লাগল। সারা বাঘের পিঠে বসে মুগ্ধ হয়ে সবকিছু দেখতে লাগল। পাহাড়, পর্বত, বন, নদী, রঙিন ফুলের বাগান, সবকিছু। সবকিছু দেখে তার মন ভরে গেল। তারপর ফিরে এলো ঘরে। মা-বাবার এখনো ঘুম ভাঙেনি। তারা ঘুমাচ্ছেই।
বাঘ বলল, এবার আসি, বন্ধু সারা।
সারা বলল, কোথায় যাবে?
তোমার খাতার ভেতর।
একটু পরে যাও। এখন বসো। গল্প করি।
নাহ। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
আব্বু-আম্মুর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাদের ঘুম ভাঙার আগেই আমাকে খাতার ভেতর যেতে হবে। বলেই বাঘটা মিলিয়ে গেল! সারা দেখল তার আর্ট খাতায় আবার দাঁড়িয়ে আছে বাঘ! তারই আঁকা বাঘ। সে খাতাটা হাতে নিল। এখন জঙ্গল আঁকবে। বাঘের ঘর আঁকবে। আর তখনই মা এসে ডাক দিল। সারা মা, সোনা মা, ঘুম থেকে ওঠ। সকাল হয়ে গেছে তো। তোমাকে ইশকুলে যেতে হবে তো।
সারা চোখ খুলে দেখল সকাল হয়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টি নেই। ঝলমলে মিষ্টি রোদ। রোদের আলো গলিয়ে পড়ছে তার বিছানায়। তার কাছে কোনো বাঘের ছবি নেই। সে বুঝতে পারল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। বাঘের স্বপ্ন দেখতে তার ভালোই লাগছিল। সে বিছানায় বসে আড়মোড়া দিয়ে বলল, মা, তুমি কোনোদিন বাঘের পিঠে উঠেছ?
মা হতভম্ব খেয়ে বলল, মানে?
মিষ্টি করে হাসল সারা। কিছু না, মা। এমনি বললাম।