শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সবুজ গাঁয়ের হাতছানি

মোস্তাফিজুল হক
  ১৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অ পু যখন প্রাইমারিতে পড়ত তখন ওদের বাড়ির পেছনে বেশ হৃষ্টপুষ্ট একটা খেজুরগাছ ছিল। শীত এলেই গাছিরা গাছে রসের হাঁড়ি ঝুলাতো। অপু মজা করে খেজুরের রস পান করত। মা রস দিয়ে পায়েস তৈরি করতেন। একদিন সেই গাছটি নিজেকে আড়াল করে ফেলল। সেই থেকে অপুদের রস খাওয়া বন্ধ হলো।

কিন্তু কীভাবে এটা হলো? একদিন একটা শালিক পাখি তার ঠোঁটে করে একটা বটফল নিয়ে এসে আয়েশ করে খেজুরগাছে বসল। হঠাৎ তার ঠোঁট ফসকে ফলটা খেজুরগাছের বাঁকলে পড়ে গেল। শালিক আর ফলটা উদ্ধার করতে পারল না।

এবার শালিক রাগে মনে মনে অভিশাপ দিয়ে বলল- এতদিন তোর বাকল ছেঁচে রস বের করা হতো, এবার তুই তোর সব হারাবি।

এদিকে শালিক উড়ে যাওয়ার পর বটফল বলল- ওহে, দয়ালু খেজুরগাছ, আমি তোমার এখানে চারা হয়ে গজাতে চাই। আমি যতদিন না বড় হই ততদিন তুমি আমাকে একটু করে রস দিয়ে বড় করে তুললে তোমার অনেক উপকার হবে।

তা কেমন উপকার হবে, আমায় বলো দেখি গো?

আমি একটু বড় হলেই তোমার বাকল ছাঁচা বন্ধ হবে। এতে তোমার কাটা ঘায়ের জ্বালা পোহাতে হবে না।

খেজুরগাছ মনে মনে ভাবতে থাকল এটা উত্তম প্রস্তাব। তাই সে দ্রম্নত বটের চারাটাকে বড় করে তুলল। মনে মনে ওটাকে তার পালকপুত্র ভাবতে লাগল।

এদিকে একবছর পরে খেজুরগাছে আঁকড়ে থাকা বটের চারা দেখে অপুর বাবা ভাবল আর রস খাওয়া নয়, কয়বছরেই একটা বড় বটগাছ পাওয়া যাবে। কিন্তু বাবা একবারও ভাবলেন না- আরেকটা খেজুরগাছ রোপণ করা দরকার!

রস সংগ্রহের পালা শেষ হলো ভেবেই খেজুরগাছ মহা আনন্দিত।

কয়বছরেই বটগাছটা খেজুরগাছকে এমনভাবে চেপে ধরেছে যে, তার দম যায়যায় অবস্থা। কিন্তু কী আর করা? এটাকে তো ছাড়ানোর ক্ষমতাও ওর নেই।

দিনে দিনে খেজুরগাছ মৃতপ্রায়। এদিকে বটগাছ ডালপালা ছড়িয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে। ডালে ডালে পাখি বসে নানা সুরে গান গায়। খেজুরগাছের মরাপাতা ছিঁড়ে পাখিরা বাসা বানায়। রোগাটে খেজুরগাছ তার অতীত জলুস আর কদরের কথা ভেবে মনে মনে দুঃখ পায়।

অপু এতদিনে দশম শ্রেণির ছাত্র। বৈশাখ এলেই বটগাছের কচিপাতা আর বসন্তবৌরি পাখির গান অপুকে মুগ্ধ করে। সে হরেক রঙের পাখি দেখে আর ওদের নাম পরিচয় খোঁজ করে। গতবছর ঝড়ের শেষে একটা ময়না পাখির বাচ্চা পেয়ে ওটাকে আদরযত্ন করে বড় করে। পাখিটা 'অপু ভাইয়া' বলে ডাকতে পারত। কিন্তু সে তার পাঠ্যবইয়ের পালামৌ গল্প পড়ে জেনেছে 'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'। তাই সে তার পোষা ময়নাটাকে ছেড়ে দিয়েছে। আর তা ছাড়া পাখি পোষার কী দরকার? বটগাছেই যেহেতু হাজার পাখির বসবাস।

অপুর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সে ভাবতে থাকে এবার পাখি বিশারদদের এনে তার বটগাছের পাখিগুলোকে দেখাবে।

কিন্তু মাঘের শেষে এবার খেজুরগাছটার অনাকাঙ্ক্ষিত বিষাদময় দিন এলো! অপুর বাবা বরাবরের মতোই টাকার অভাব হলেই নির্বিচারে গাছ বেচে দেন। এবার বটগাছ বেচার পালা। ডালপালা কর্তন চলছে। বটগাছটার মোটেই মন ভালো নেই। তার হঠাৎ করেই শালিকের কথা মনে পড়ে গেল! কিন্তু কোনো লাভ নেই।

তাই সে জনমের কান্না কেঁদে নিল! অবশ্য সেদিন অপুর চোখেও জল ছিল। কিন্তু কিশোর অপুর ছিল না কোনো ক্ষমতা।

ফাগুনের শুরু থেকেই অপুর মন ভীষণ খারাপ। একটা পাখিরও আনাগোনা নেই! নেই পাখিদের মধুময় কলকাকলি! পাখিরাই বা কেন আসবে? অপু চাইলেই তো পাখিরা এসে গান জুড়বে না!

অপুর বাবা ভীষণ খুশি। পকেটে এসেছে বটগাছ বেচার বাড়তি পনেরো হাজার টাকা। অপু ভাবতে থাকে, বটগাছটা যেমন খেজুরগাছকে গ্রাস করে মিষ্টি রস থেকে বঞ্চিত করে মহানন্দে বেড়ে উঠেছিল, তেমনি তার বাবাও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আজ হেসে উঠেছে।

অপুর বাবা অপুকে একটা নতুন হাতঘড়ি কিনে দিতে চাইল। কিন্তু অপুর দাবি হলো- হাতঘড়ি নয়, এবার বর্ষায় দশটা গাছের চারা কিনে দিতে হবে।

অপুর বাবা বলল- গাছ আবার লাগাতে হয় নাকি? আচ্ছা, বটগাছটা কি আমি লাগিয়ে ছিলাম নাকি?

বাবা, আমাদের চারপাশে গাছ কমে এসেছে। তাই গাছ রক্ষা ও পরিচর্যায় উদ্যোগী হতে হবে। কেননা, গাছ আমাদের বন্ধু। গাছই আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগায়, বিষাক্ত কার্বন শুষে নেয়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। খাদ্য-ওষুধ, আসবাবপত্রের কাঠের জোগান দেয়।

বটগাছ দিয়ে কি কাঠ হয়? আর আমরা না বিক্রি করলে মানুষ জ্বালানিকাঠ কোথায় পাবে?

বাবা, এটা কাটার আগে পাখি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা ভেবে দুই-একটা গাছ বড় করে তোলা উচিত ছিল।

'হয়েছে হয়েছে, আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না'- বাবার এমন কথায় অপু আর কথা বাড়াল না।

কয়দিন পরেই কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল। ঝড়ে অপুদের ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেল! ঘর মেরামত করতে অপুর বাবার প্রায় বিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল!

এরপর একসপ্তাহ চলে গেছে। একদিন বিকালে অপুর বাবা শহর থেকে ফিরে অপুকে কাছে ডাকলেন।

'অপু, এবার জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আমরা বৃক্ষরোপণ অভিযানে নামব। শুধু আমাদের পতিত জমিতেই নয়, সারা গ্রামের রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগাবো। এই নাও তোমার ঘড়ি, ক্যালেন্ডার আর ডায়েরি। তুমি দ্রম্নত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করো। মনে রাখবে, কাজটা কিন্তু অনেক সময় ও শ্রমসাপেক্ষ। তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে রাখতে পারলে কাজটা সহজ হবে।'

অপুর আনন্দের আর শেষ নেই। আজ জুলাই মাসের প্রথম শুক্রবার। পাড়ায় উৎসবমুখর পরিবেশে বৃক্ষরোপণ অভিযানের আয়োজন চলছে। প্রথমেই 'গাছের চারা রোপণ ও বৃক্ষ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান চলল। অপুর বাবার বন্ধু সবুজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি অপুর বাবার মুখে সব ঘটনা শুনে অপুকে 'বৃক্ষবন্ধু' বলে আখ্যায়িত করলেন। এরপর দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ অভিযান চলল।

অপু আজ যেন আবার কল্পনার চোখে তার সেই হারিয়ে যাওয়া পাখিদের গান শুনতে পাচ্ছে। এক নির্মল সবুজ গাঁয়ের ছবি যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে যাচ্ছে। ও যেন শ্যামল প্রান্তরে বয়ে যাওয়া মৃদু বাতাসের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে- 'এসো হে বন্ধু, আমার ছায়ায় বসো। আমি তোমাকে পাখির কণ্ঠে গান শোনাবো।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57851 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1