শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কবুতরের খোপ

আরাফাত শাহীন
  ২৯ জুন ২০১৯, ০০:০০

পু কুরপাড়ে বড় আমগাছটির গোড়ায় চুপচাপ বসে আছে রাতুল। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় তার মনটা ভালো নেই। আসলেই তাই। গত দুদিন ধরেই তাকে বেশ মনমরা দেখা যাচ্ছে। কোথাও সে যাচ্ছে না। তার মন খারাপের পেছনে কারণ অবশ্য রয়েছে।

রাতুলের কবুতর পোষার বড় শখ। ছোটমামার কাছ থেকে গতবছর দুইজোড়া বাচ্চা কবুতর এনে সে পোষা শুরু করেছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দশটা কবুতর হয়েছিল। দারুণ সুন্দর সুন্দর বাচ্চা হতো কবুতরের। রাতুল বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলতে লেগে যেত। সুন্দর সুন্দর চোখ মেলে তারা চেয়ে থাকত রাতুলের চোখের দিকে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা তাকে প্রশান্তি এনে দিত।

গতকাল রাতে ওরা কেউ বাড়িতে ছিল না। মামাবাড়ি গিয়েছিল। মামাতো বোন সুমির বিয়ে উপলক্ষে তাদের সবাইকে যেতে হয়েছিল। আম্মু যখন রাতুলকে এসে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলেন, প্রথমেই তার মনে পড়ল কবুতরগুলোর কথা। রাতুল বলল, 'তোমরা না-হয় যাও। আমি বাড়িতে থেকে যাই।'

আম্মু যারপরনাই বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, 'আমরা সবাই যাব আর তুমি থাকবে- এর মানে কী?'

রাতুল আম্মুর মনোভাব বুঝতে পারল। সে আস্তে আস্তে বলল, 'আমি চলে গেলে আমার কবুতরগুলোকে দেখবে কে? ওদের খোঁজখবর নেবে কে?'

রাতুলের কথা শুনে আম্মু হেসে দিলেন। তারপর প্রশ্নের সুরে বললেন, 'এই সামান্য কারণে তুমি যেতে চাচ্ছো না?'

আম্মুর প্রশ্ন শুনে রাতুলের মনে অভিমান জমে উঠল। অভিমানের সুরে সে বলল, 'তুমি এটাকে সামান্য কারণ কেন বলছ আম্মু? বাড়িতে কেউ না থাকলে ওদের যে-কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কেউ এসে যদি চুরি করে নিয়ে যায়!'

আম্মু বললেন, 'কিচ্ছু হবে না। তুমি এত বিচলিত হচ্ছো কেন?'

রাতুল বলল, 'ক'দিন আগেই তো শামীমের কবুতরগুলো কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেল! বাড়িতে কেউ না থাকলে আমারগুলোও নিয়ে যেতে পারে।'

রাতুলকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। আম্মু ব্যর্থ হয়ে আব্বুকে গিয়ে বললেন, 'তোমার ছেলে তার কবুতর ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। তুমি গিয়ে দেখ ম্যানেজ করতে পারো কিনা।'

আব্বু রাতুলের রুমে এসে বললেন, 'বাবা রাতুল, তুমি না গেলে হয় না। তোমার মামার একমাত্র মেয়ে, তুমি যদি না যাও তাহলে চলবে কেন! তোমার আপু খুব মন খারাপ করবে।'

'কিন্তু আমার কবুতর...'

রাতুল কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই আব্বু বললেন, 'একটা রাতে কিছুই হবে না। প্রয়োজনে আমি রতনদের বলে যাবো। ওরা একটু দেখাশোনা করবে।'

'ঠিক আছে আব্বু।'

রাতুল মাথা নেড়ে সায় দিল। বোঝা যাচ্ছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে রাজি হতে হয়েছে।

মামাবাড়িতে ওরা একটি রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই ফিরে এসেছিল। কিন্তু ফিরে এসে যা দেখল তাতে শুধু রাতুলই নয়, সবাইকেই মাথায় হাত দিতে হয়েছে। এতবড় ক্ষতি হয়ে যাবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। খোপসুদ্ধ কবুতরগুলো কে বা কারা নিয়ে গেছে। রাতুল কান্না সামলাতে পারল না। হু হু করে কেঁদে দিল। আম্মুও সহ্য করতে পারলেন না। তিনি বললেন, 'রাতুল যেতে চাচ্ছিল না। ওকে যদি রেখেও যেতাম তাহলে এমন ক্ষতিটা হতে পারত না।'

আব্বু সান্ত্বনা দিলেন রাতুলকে। তিনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'কেঁদো না বাবা। আমি তোমাকে আবার কবুতর কিনে দেবো।'

কিন্তু কোনো সান্ত্বনাতেই রাতুলের মন মানতে চায় না। এতদিন ধরে এত কষ্ট করে আজ এমন দুর্ভোগ পোহাতে হলো!

আব্বু কবুতরের খোপ এবং কবুতর এনে দেবেন বলেছেন বটে। কিন্তু তিনি একদমই সময় পাচ্ছেন না। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। রাতুল সব বুঝতে পারে। তাই সেও চুপ করে আছে।

আমতলা বসে রাতুল ভাবলো- আব্বু হয়তো সময় পাবেন না। আমার নিজেকেই খোপ বানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সে নিজে তো খোপ বানানোর কিছুই বোঝে না। তাহলে উপায় কী? এই সমস্যার সমাধান সে কিছুতেই করতে পারছে না। মন খারাপের কারণ এখন এটাই।

'কী হয়েছে রাতুল? এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?'

রাতুলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু সজল এসে বলল। এই ক'দিন সজলও বাড়িতে ছিল না। সে-ও কোথাও গিয়েছিল।

'এই দু'দিন কোথায় ছিলি তুই?'

প্রশ্ন করল রাতুল।

সজল ওর মুখের দিকে চেয়ে বেশ অবাক হলো। তারপর বলল, 'খালাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর কী হয়েছে বল্‌ তো?'

রাতুলের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বলল, 'আমার সর্বনাশ হয়েছে সজল। কারা যেন খোপসুদ্ধ আমার কবুতরগুলো চুরি করে নিয়ে গিয়েছে।'

কেঁদে ফেলল রাতুল।

সজল জানে, রাতুল ওর কবুতরগুলোকে কতটা ভালোবাসে। রাতুল বলে, জগতে তুই হলি আমার প্রথম দোস্ত, আর আমার কবুতরগুলো হলো দ্বিতীয় দোস্ত।

সুতরাং সেই কবুতরগুলো হারিয়ে যাওয়া রাতুলকে কতটা আঘাত দিয়েছে সজল তা অনুভব করল। তার মনটাও বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।

সজল বলল, 'তাহলে এখন কী করতে চাস? সারা পাড়ায় খোঁজ করব নাকি?'

'তাতে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। যতটুকু খোঁজ করা সম্ভব আমি আর আব্বু মিলে করেছি।'

'তাহলে কী করবি বলে ভেবেছিস?'

প্রশ্ন করল সজল।

রাতুল বলল, 'আমি আবার কবুতর পোষা শুরু করব। কিন্তু খোপ বানাতে পারি না যে! আব্বুরও এদিকে তাকানোর সময় নেই।'

সজলের চোখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে বলল, 'একদম চিন্তা করবি না। সব হয়ে যাবে।'

রাতুল উৎসুক হয়ে উঠল। সে বলল, 'কীভাবে হবে? তুই বানাতে পারিস?'

'আমি পারি না ঠিকই। তবে ছোটমামা বানাতে পারেন। গতকাল মামা এসেছেন। তাকে গিয়ে ধরলে অবশ্যই বানিয়ে দেবেন।'

রাতুল বলল, 'সে না-হয় বুঝলাম। কিন্তু বাঁশ আর কাঠ কোথায় পাবো?'

'আরে গাধা, আমাদের বাড়িতেই তো বাঁশ রয়েছে। এত চিন্তা করছিস কেন?'

রাতুলের খুশি যেন আর ধরে না। সে বলল, 'তাহলে চল্‌ এখনই মামাকে গিয়ে ধরি। আমার একদম তর সইছে না।'

একমাত্র বন্ধুর এমন ছেলেমানুষী দেখে সজল হেসে ফেলল। তারপর বলল, 'ঠিক আছে। চল্‌ তাহলে যাওয়া যাক।'

'রাতুল সাহেব, কেমন আছেন?'

রাতুলকে দেখে একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন মামা। তিনি ওকে এভাবেই সম্বোধন করেন। রাতুলের ভারি লজ্জা লাগে। মাথা নিচু করে রাতুল বলল, 'আমি ভালো আছি মামা। আপনি কেমন আছেন?'

'আমিও বেশ আমোদে আছি। বোনের বাড়িতে এসে এমন জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার পর খারাপ থাকি কীভাবে!'

মামা বেশ আমুদে মানুষ। তার কথা শুনে রাতুল হেসে দিল। সজলের মুখেও দেখা গেল হাসির রেখা।

মামা বললেন, 'তা সকাল সকাল কী মনে করে আসা হয়েছে? শুধুই বেড়াতে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?'

সজলের দিকে চেয়ে চোখ ইশারা করলেন মামা। রাতুল আড়চোখে সেটা দেখলেও মর্মার্থ বুঝতে পারল না কিছুই।

সে বলল, 'একটা কাজে এসেছি আপনার কাছে। আমার একটা কবুতরের খোপ বানাতে হবে।'

মামা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, 'এটা নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। এই জুলফিকার মামা যখন রয়েছে...'

তিনি হো হো করে হাসতে লাগলেন।

সজলের দিকে চেয়ে মামা বললেন, 'যাও নিয়ে এসো। বেচারার তর সইছে না।'

সজল চলে গেল। রাতুল প্রশ্ন করল, 'ও কী আনতে গেল মামা?'

'সামান্য একটু ধৈর্য ধরো বাচা।'

মামার ঠোঁটে তখনও হাসি ঝুলে রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর সজল একটা কবুতরের খোপ নিয়ে ভোজবাজির মতো উদয় হলো। খোপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল রাতুল। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

রাতুলের কিংকর্তব্যবিমুঢ় ভাব দেখে মামা ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, 'আমি এখানে এসে গতকাল বিকালে তোমার খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। তুমি তখন বাড়িতে ছিলে না। তোমার আম্মুই বললেন কবুতর চুরি হয়ে যাওয়ার কথা। ফিরে এসে আমি আর সজল মিলে বাঁশ কেটে রেখেছিলাম। সকালে এটা বানিয়ে ফেলেছি। আর হঁ্যা, দুটো ছানাও জোগাড় করে এনেছে সজল।'

রাতুল উঁকি দিয়ে দেখল, খোপের ভেতর ধবধবে সাদা রঙের দুটো ছানা বসে রয়েছে। তারা কুচকুচে কালো দু-চোখ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।

রাতুলের চোখে পানি চলে এলো। এবার আর কান্নায় নয়, সজল এবং মামার প্রতি কৃতজ্ঞতায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55703 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1