মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘ

মো. গোলাম মোর্তুজা
  ২৫ মে ২০১৯, ০০:০০

মেঘ বাবুর মনের ব্রহ্মান্ড বড়ই ছোট। একটু মেঘের গুড়ুম হলে কী দৌড়াদৌড়ি করে এ ঘর থেকে ও ঘর, এ বারান্দা থেকে ও বারান্দা। বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি মিলে নাম রেখেছেন মেঘ। বাড়িতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একমাত্র মেঘকেই পাওয়া যায় বলেই আদরে-আপ্যায়নে 'বাবু' শব্দটি মেঘের সঙ্গে লেপটে গেছে।

সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। মেঘের ফাঁক-ফোকরে এক ফালি রৌদ্রও ঝিলিক দিচ্ছিল। আকাশে বেড়ে ওঠা শান্ত সফেদ মেঘগুলো কখন যে রং বদলিয়ে বিশ্রী কালো হয়েছে তা মেঘের বাড়ির কেউ-ই দেখেননি। কারও দেখা বা না দেখার ওপর ভর না করে সেদিন বুড়ো আকাশ ঝপাত করে ঝরিয়ে দিল বৃষ্টি। স্থায়িত্ব পাঁচ মিনিট।

ভয়ে ভয়ে-দৌড়ে দৌড়ে-মিনমিনে ভঙিতে মেঘ বাইরে দেখছে। চনমনে বাতাস মেঘের শরীরে লাগল। মেঘ তাতে শিহরিত হয়ে নামল উঠোনে। উঠোনে থাকা বাতাবি লেবুগাছের তলায় ওত পেতে দাঁড়ায় ও। যখন ধুম করে পড়বে লেবু, তখনই হাতে নিয়ে দেবে ঘরে দৌড়। তবে বিদু্যৎ চমকালে বেচারাকে বাইরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে সময়ে দাদুর কাছে গল্প শোনার একমাত্র পাঠক বনে যাবে। ওর প্রতি বাড়ির সবারই একটা আলাদা নরম জায়গা আছে। স্কুলে ভর্তিও করা হয়েছে বয়সের আগেই। সবার চাওয়া ছেলেটা স্কুলে যাতায়াত করুক। যত পারে বই ছিঁড়ে ফেলুক- তবু কিছু শিখবে তো। স্কুলে যেতে যেতে মেঘের বর্ণমালা পরিচয় হয়ে গেছে। বর্ণ দেখলেই বিনিসুতোর মালার মতো ক্রমেই বর্ণকে ধরে চলতে পারে। বাবা শফি একদিন রাতে বর্ণমালার বই দেখিয়ে বলেন, 'বাবা এই বর্ণের নাম কী বলো তো?' শফি সাহেব শিক্ষক। সময় হয় না ছেলেকে সময় দেয়ার। তবে আজ কী মনে হলো মেঘকে নিয়ে বসতেই মেঘ সব বর্ণের নাম সহজ ও সুন্দর করে তরতর করে বলে ফেলল। শফি সাহেব তাজ্জব। ছেলে মেঘ এই এতটুকু বয়সে এতটা শিখেছে। বড় হলে ছেলে করিতকর্মাই হবে ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। হঠাৎ-ই মেঘ গদাম করে বাবাকে একটি কিল মেরে পালায়। এ দুরন্তপনাতে বাবা খুশি। 'কেন মারলে বাবা, কেন মারলে?' বাবার কথায় মেঘ বলল, 'আমার জন্য আজ চকোলেট আনোনি কেন? তাই বসায়ে দিয়েছি গদামকিল।' ছেলের কথা শুনে হা হা করে হাসেন শফি সাহেব। ছেলেকে প্রতিদিন চকোলেট খাওয়ান তিনি। বিশেষ কোনো দামি চকোলেট নয়- এক-দু'টাকা দামের। স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসেন। ছেলেকে নিয়ে তিনি স্বপ্নের ছক সময়ের কাছে কেটে কেটে রেখেছেন। 'বাবা সোনা মেঘ স্যরি চকোলেট আনতে ভুলে গেছি। কাল নিশ্চয়ই আনবো।' বাবার কথা শুনে মেঘ ডান হাত উঁচিয়ে বিজ্ঞের ভাব নিয়ে বলে, 'ওকে, ওকে বাবা। নিজের মানুষকে স্যরি বলতে নেই। দাদু বলেছেন পর মানুষের বেলায় ভুল করলে স্যরি বলতে হয়। তুমি আমার আপন। ওকে বাবা কাল নিয়ে এসো।' ছেলের কথা শুনে শফি সাহেব অবাক হয়ে পরক্ষণেই সবাক হয়ে বলেন, 'বাবা সোনা এসো আমার কাছে কত্ত কথা শিখে নিয়েছে আমার মেঘ বাবু।' তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে দু'গালে দু'টো দু'টো করে চারটি চুমোর উষ্ণতা ছড়িয়ে দিলেন। মেঘ বাবু খুশিতে বাগবাগ হয়ে বলল, 'ছাড়ো বাবা। আমার কাজ আছে। দাদিমাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে তা ছাড়া দাদুভাই আজ আমায় একজন সফল মানুষের গল্প শোনাবেন বলেছেন। আচ্ছা বাবা, মানুষ তো মানুষই, মানুষ আবার কী করে সফল হয়? শফি সাহেব ছেলের চোখের দিকে তাকালেন। ছেলের চোখজোড়া যেন অসাধ্য সাধন করার বিশ্বাসে খোদাই করা। মেঘকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। 'বাবা পড়াশোনা শিখে ভালো মানুষ হওয়া যায়। আর ভালো মানুষই সফল মানুষ। তোমার দাদুর কাছে থেকে আরও শুনে নিও। তোমার দাদু একজন সফল মানুষ।'

বাবার কথা শেষ হতে না হতে মেঘ ফড়িংয়ের মতো তিড়িং-বিড়িং করতে করতে দৌড় দিল দাদুর উদ্দেশ্যে। মেঘের মা তখন রান্না ঘরে। মাথা ঘুরে রান্না ঘরের মেঝেতে পড়ে গেছেন। মাথা ফেটে রক্ত ঝরে। ক'দিন থেকে তার প্রেসারটা বেশি, ডায়াবেটিসটাও বেড়েছে, শরীরটা দুর্বল। মেঘ মায়ের কাছে একবার ল্যান্ড করে আবার দাদুর উদ্দেশে ফ্লাইং করবেন। মায়ের কাছে রান্না ঘরে যেতেই মেঘ চিৎকার দিল। 'বাবা ও বাবা মায়ের যেন কী হয়েছে-।' শফি সাহেব ছুটলেন। 'কী হয়েছে বাবা? তোমার মায়ের কী হয়েছে?' মেঘের ও শফি সাহেবের চেঁচামেচি শুনে বাঁচি কী মরি করে মোয়াজ্জেম সাহেব দ্রম্নত হাঁটা শুরু করেছেন। 'দাদু, ও দাদুভাই কী হয়েছে তোমার মায়ের? আলস্নাহ সাহায্য করো।'

মেঘের মাকে সবাই মিলে বিছানাই তুলেছেন। মাথা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। শফি সাহেব মাথাটা ধরলেন চেপে তবু রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ফিনকি দিয়ে ছোটে রক্ত। এবার কাপড় দিয়ে চেপে বাঁধলেন মাথাটা। বাঁধার দুই মিনিটের মধ্যে রক্ত বন্ধ হলো। মেঘকে বললেন, 'বাবা কেঁদোনা। যাও তো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে অ্যানটিসেফটিক ক্রিম ও তুলো আছে নিয়ে এসো।' মেঘ মায়ের ডান হাত নাড়ছিল আর কাঁদছিল। এবার দৌড় দিল। এক লহমায় এনে দিল সব। মায়ের পাশে আবার গিয়ে বসল। 'মা ওমা, কী হলো তোমার? কথা বলো।'

শফি সাহেব নিজের ভেতরের সঞ্চিত সহিষ্ণুতা ধরে রাখতে পারছেন না। বাবা মোয়াজ্জেমের চোখে-মুখেও নিস্তব্ধ গুমোট আবহাওয়ার রেশ। মেঘের আম্মুর জ্ঞান ফেরেনি এখনো। মোয়াজ্জেম সাহেব ছেলেকে বললেন, 'বাবা শফি বৌমাকে হাসপাতালে নাও। জ্ঞান তো ফিরছে না। দেরি করো না।' বাবার কথা শুনে শফি সাহেব কোনো কথা না বলে দ্রম্নত গায়ে জামাটা ঢুকিয়ে বের হলেন বাইরে। আর ওদিকে মেঘ দাদুর সব কথা শুনে আরও জোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করল। 'মা, ওমা, মাগো, কথা বলো। কথা বলছ না কেন? আমি আর দুষ্টুমি করব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব। প্রতিদিন পড়তে বসব, স্কুলে যাবো। ডাক্তার হবো। ওঠো মা।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50918 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1