বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টিয়াপাখি ও রেডিও

ফখরুল হাসান
  ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটা রেডিওতে শোনাবে, সেই জন্য সুলতান মাস্টারের বাড়িতে দুপুরের পর থেকে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে দলে দলে মানুষ এসে হাজির হতে লাগল। কারণ, আশপাশের কোনো গ্রামে রেডিও নেই। সুলতান মাস্টার রেডিওর নব ঘুরিয়ে চালু করতেই রেডিওতে মিলিটারির হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা যায়। আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার। সুলতান মাস্টারের একটু মন খারাপ হলেও সবাইকে থামতে বলল। কিন্তু ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা। 'রফিকের মা সবাইকে চা দাও' ভেতর থেকে জবাব এলো 'আমি তো বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা রেডিওতে শুনতে চাচ্ছিলাম' দুজনের কথা বলার মধ্যেই হঠাৎ রেডিওতে একজন রেসকোর্সের বর্ণনা দিচ্ছেন। কমপক্ষে বিশ লাখ মানুষ এসেছে আজকে। এর আগে মনে হয় পৃথিবীর কোনো দেশে একজন নেতার ভাষণ শুনতে বিশ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে বলে মনে হয় না। আপনারা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা আপনাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ভাষণ শুরু হতে যাবে ঠিক তখনই রেডিও থেকে প্রচার বন্ধ করে দিল। উঠোনে বসা মানুষজনকে হতাশ দেখে সুলতান মাস্টার তাড়াতাড়ি রেডিওর নব ঘুরিয়ে অন্যান্য স্টেশনগুলো শোনার চেষ্টা করলেন। রেডিওর নব ঘুরিয়ে আকাশবাণী শুনে বুঝতে পারলেন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছে। তিনি বাঙালিদের উদ্দেশে বলেছেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম' 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম' 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করবা' রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনে উপস্থিত মানুষের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ৭ মার্চের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান চলছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান মিলিটারি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কিন্তু ঢাকা শহরজুড়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা। ২৫ মার্চ কালরাতে কত লোক মেরেছে তার কোনো হিসাব নেই। পুরো শহরটা মনে হয় ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান মিলিটারি। বিদেশি সাংবাদিকদের ধরে জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি সাংবাদিকরা এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় যেটুকু দেখেছে তাতেই সাংবাদিকরা পুরোপুরি স্তম্ভিত। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। বিবিসিতে খবরটা শুনে বিষণ্ন মন নিয়ে কাছারি ঘরে বসে আছে সুলতান মাস্টার। এখন দেশের খবর জানার একমাত্র ভরসা রেডিও। বিদেশি কোনো রেডিও স্টেশন থেকে ইংরেজিতে খবর হলে সেটা বাংলায় বুঝিয়ে দেয় সুলতান মাস্টার, বাড়িতে ভিড় করা মানুষের। ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশে ছোট একটি গ্রাম ঠিক যেন ছবির মতো। ধুলজুরী গ্রামকে ঘিরে আছে দুটি বিল একটি নদী। গ্রামের দক্ষিণ পাশে ব্রহ্মপুত্র নদী, পশ্চিম পাশে চাতল বিল, উত্তর পাশে খাটিয়াল বিল। পূর্ব পাশে ছোট ছায়াঘেরা সবুজ গ্রামটিতে চলাচলের উপযোগী একটি মাত্র রাস্তা। এটিকে গ্রাম না বলে অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ বললেও ভুল হবে না। বর্ষাকালে চারদিক দিয়েই যাতায়াত করা যায় নৌকা দিয়ে। শুকনো মৌসুমে দুই বিল দিয়ে যাওয়া যাবে। তবে পায়ের নিচে আর জুতা ঠিক থাকবে না। কারণ হাঁটু পর্যন্ত জল থাকে বিল দুটিতে। দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। তার বাতাস এসে লাগল ধুলজুরী গ্রামেও হঠাৎ করে কেমন জানি মানুষের মধ্যে চিন্তার ছাপ। শান্ত গ্রামটিতে দিনে মিছিল-মিটিং 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' আরও একটি স্স্নোগান দেয় 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো' আর রাতে নামে নীরবতা। রাত হলে মনে হয়, এই গ্রামে কখনো কোনো দিন মানুষের বসবাস ছিল না। যদিও পাকিস্তানি মিলিটারি এ গ্রামে আসার কোনো রাস্তা নেই। একমাত্র চলাচলের উপযোগী রাস্তাটির কালভার্ট ভেঙে দিয়েছে এলাকার মানুষ। কালভার্ট ভাঙার বুদ্ধিটা সুলতান মাস্টারের।

সন্ধ্যাবেলা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। সুলতান মাস্টার চিটাগাং রেডিও স্টেশন চালু করে শোনে। সারা দেশে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাই বলছে চিটাগাং রেডিও স্টেশন থেকে। মিয়ারা শোনো আর বেশিদিন সময় লাগবে না পাঞ্জাবিদের তাড়িয়ে দিতে আমাদের ছেলেরা প্রাণপণে যুদ্ধ করছে। এদিকে আকাশবাণী কলকাতা থেকে আমার সোনার বাংলা গানটা শোনাচ্ছে। আরও কয়েকটা গান শেষ করে একবার বলল পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকিস্তান মিলিটারির সঙ্গে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছে যশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, খুলনা এসব জায়গায় পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে বাঙালিদের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছে। সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছে খুলনা থেকে বাগেরহাট যাওয়ার পথে রেললাইনে মাইন পেতে রাখে এক বিচ্ছু গেরিলা। ইঞ্জিনসহ লন্ডভন্ড তিনটি বগি। ছিন্নভিন্ন হানাদার বাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে চারদিকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবরটা শোনো জয় বাংলা বলে চিৎকার করে উঠল সুলতান মাস্টারসহ গ্রামের মানুষ। পরেরদিন আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছে। নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ স্কুলে আর্মিদের ক্যাম্প আক্রমণ করছে গেরিলারা! খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট ছিল। জীবন-মৃতু্য দুটোর মুখোমুখি ছিল গেরিলারা। গ্রেনেড, ৩০৩ রাইফেল, এসএলআর, আর দুটি এসএমজি তাদের সম্বল ছিল। সারারাত যুদ্ধ করে ফজরের আজানের আগে শত্রম্ন ব্যাংকারের কাছাকাছি গিয়ে একের পর এক গ্রেনেড চার্চের মাধ্যমে ভোরবেলা অপারেশনে জয়ী হয় গেরিলারা। একের পর এক যুদ্ধ জয়ের সংক্ষিপ্ত খবর প্রতিদিন শুনতে পায় ধুলজুরী গ্রামের মানুষ। সুলতান মাস্টারের রেডিওর কল্যাণে। আনন্দে আত্মহারা গ্রামের মানুষ। হঠাৎ একদিন খবর এলো ধুলজুরী গ্রামে আসছে মিলিটারি। এই সংবাদটি নিয়ে আসে সুলতান মাস্টারের ছোট ছেলে হেলাল উদ্দীনের টিয়াপাখি। পাশের গ্রামের কাসেম মোলস্নার বাড়িতে কয়েকজন রাজাকার বসে আলোচনা করছে। ধুলজুরী গ্রামে মুক্তিদের ঘাঁটি। সেটা মেজর সাহেবকে জানাতে হবে। হেলাল টিয়াপাখিটা অনেক বছর ধরে পোষে। তাই সে মানুষের মতো কথা বলতে পারে। খবরটা সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে গেছে গেরিলা কমান্ডার সালামের কাছে। কমান্ডার এসে সুলতান মাস্টারকে বুঝিয়ে বলল, কিছুদিন যেন গ্রামের কোনো মানুষ নৌকা নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীতে না যায়। কারণ মিলিটারি এলে ওই নদীপথেই আসবে। খাটিয়াল বিল জলে টইটম্বুর। বর্ষাকালে এই বিলে পানি থাকে। কাকের চোখের মতো টলমলে পানি। আর তাতে ভাসছে শাপলা, নানান জাতীয় ফার্ন আর কচুরিপানা। সেই দৃশ্য ভারি সুন্দর। সারাবিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরেকরকম মাছ। কই, শিং, পুঁটি, টেংরাসহ নানান প্রজাতির মাছ। তবে মাঝেমধ্যে বড় বড় শোল মাছও ধরা পড়ে। গৃহস্থের হাঁসগুলো ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায় বিলের জলে। সে দৃশ্য না দেখলে জীবনটাই বৃথা। বিলে মাছ ধরার জন্য নৌকা নিয়ে নেমেছে আজিজ, লিয়াকত। হঠাৎ ওপার থেকে রাজাকার কাসেম মোলস্নার ডাক। নৌকা নিয়ে কিনারে যেতে বলছে। চিন্তায় পড়ে যায় তারা। নৌকা নিয়ে পালাবো সে সময় নেই। তাহলে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই। নৌকা কিনারে নিয়ে গেলে তাদের গ্রামে মিলিটারি আক্রমণ করবে। দুজন চিন্তা করে বুদ্ধি বের করে। হয় মরব, না হয় মিলিটারি মারব। 'আজিজ ভাই কি করতে চাও তুমি?' কেন মিলিটারিকে আমাদের গ্রামে ঢুকতে দেব না। জানপ্রাণ দিয়ে দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে মুক্তিরা। কিন্তু ওরা তো অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করছে। আমরা করব বুদ্ধি দিয়ে। সুযোগ বুঝে ওদের মাঝ বিলে ফেলে দেব। বড় নৌকাতে উঠে পড়ল পনের ষোল জন মিলিটারি। মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন আবার আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকছে। মাঝ বিলে এসে আজিজ আর লিয়াকত নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর ঝট করে নৌকার কিনারে ধরে ঝুলে পড়ল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে হড়হড় করে পানি ঢুকতে লাগল নৌকায়। দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিলের পানিতে পড়ে গেল। তারপর হাবুডুবু খেতে লাগল। আরেক টানে নৌকা পুরোপুরি ডুবিয়ে দিয়েছে দুজন। ওদিকে সাঁতার না জানা পাকবাহিনী বেশির ভাগ মিলিটারি পানি খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে। বাকি মিলিটারিগুলোও হাবুডুবু খেতে খেতে সেই রাস্তা অনুসরণ করতে লাগল। আজিজ আর লিয়াকত জয় বাংলা বলে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45609 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1