শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

বাবার মুখে দাদুর কথা

মোহাম্মদ অংকন
  ২৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

জিতুর বয়স ছয় বছরের বেশি হবে না। মাত্র পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছে। ছোট ছোট বই পড়ে, টিভিতে কার্টুন দেখে। নানা কিছু শিখে, নানা কিছু জানে। ক'দিন ধরে ওর মাথায় 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো এক ছড়া-কবিতায় শব্দটি পড়েছে। তাই বাবাকে রাতে সে প্রশ্ন করে বসে। 'বাবা মুক্তিযুদ্ধ কি?' বাবা অবাক হয়ে যায়! মনে মনে ভাবে, 'ছেলে হঠাৎ এমন প্রশ্ন তুলছে কেন?' ছেলের আগ্রহবোধ দেখে বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা দিতে মোটেও কালবিলম্ব করে না। জিতু বাবাকে আরও নানাবিধ প্রশ্ন করতে থাকে। 'বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি কত বড় ছিলে? আম্মু বলেছে, আমার দাদু নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? সত্যই কি? আমায় তুমি বলনি কেন?'

\হজিতুর বাবা বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। ছেলের মুখে মুক্তিযোদ্ধা বাবার কথা শুনতেই চোখের কোণে দু'ফোঁটা জল চলে আসে। 'হঁ্যা, তোমার দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, ঠিক আমি তোমার বয়সী ছিলাম। আমার মুক্তিযুদ্ধের কথা খুব বেশি মনে পড়ে না। তবে যেটুকু মনে রয়েছে, তাও কম নয়। হয়তো সে সময়ের কথা শুনলে ভয়ে তোমার বুক কেঁপে উঠবে।' জিতু বাবাকে বলে, 'তাহলে বাবা আমাকে তুমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাও। তোমার মুখে মুক্তিযোদ্ধা দাদুর কথা শুনতেই চাই। আমি মোটেও ভয় পাব না। দাদু বেঁচে থাকলে আমি না হয় তার মুখ থেকে শুনতাম।' জিতুর বাবা তার আদরের সন্তানকে রাতভরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বাবার গল্প শোনাতে থাকে।

বাবা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। ফজরের নামাজ পড়তেন। আমিও বাবার সঙ্গে উঠে পড়তাম। মা বাবাকে সকালের সূর্য ওঠার আগেই পানতা ভাত খেতে দিতেন। বাবা চটজলদি সেগুলো খেয়ে এক জোড়া হালের গরু নিয়ে মাঠে ছুটে যেতেন। আমি প্রায়ই বাবার কাঁধে উঠে জমিতে যেতাম। বাবা জমি চাষ করতেন, আর আমি জমির আইলে বসে থাকতাম। বাবার কাজ শেষ হলে বাড়ি ফিরতাম।

তখন ১৯৭১ সাল। ২৭ মার্চ সকালের দিনটা আমার ভীষণ মনে পড়ে। বাবার সঙ্গে সেদিনও আমি মাঠে গিয়েছিলাম। বাবা মাঠে হাল চাষ শুরু করতে না করতেই কোথা থেকে যেন শত শত বিমান উড়ে আসতে থাকে। বাবা অবাক হয়ে যান। আমাকে বলে, 'আমি কোনো দিন এত বিমান দেখিনি।' আমিও ভয়ে কাঁপতে থাকি। বাবা রেডিওতে শুনেছিলেন, দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। তাই তার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে কেন এত বিমান আকাশে উড়ছে। কিন্তু আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। বাবা আমাকে নিয়ে খুবই দ্রম্নত বাড়ি ফিরে যায়।

বাবা দুপুরের দিকে রেড়িওটা চালু করেন। খবর ভেসে আসে- সারা দেশে পাক-হানাদার বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। সবাইকে নিরাপদে থাকতে হবে। প্রয়োজনে সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যও রেড়িওতে আহ্বান করা হয়। এসব আহ্বানের মধ্যে একজন নেতার বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রায়ই শোনা যেত। উচ্চকণ্ঠে ভেসে আসত- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' আরও অনেক কথাবার্তা। এই ভাষণটি কে উচ্চারণ করতেন, আমি তখন জানতাম না। মুক্তিযুদ্ধের পরে জেনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের ভাষণকর্তা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের রেখে বাবা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাবেন? এ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। তার ভাবনা, একটি পরিবারই একটি দেশ। তাই বাবা আগে পরিবারকে রক্ষার কথা ভাবেন। বাবার মাথায় অনেক বুদ্ধি ছিল। পাক-হানাদার বাহিনী যাতে আমাদের বাড়িতে খুঁজে না পায় সে জন্য বাবা বাড়ির উঠোন খুঁড়ে টিনের চালা দিয়ে গোপন আস্তানা তৈরি করেছিলেন। আমরা সবাই সেখানে লুকিয়ে থাকতাম। আমাদের সমগ্র পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, সেখানেই ঘুম হতো। জেলখানার চেয়েও ভয়ঙ্কর! তখন বোধহয় এটাই ছিল বাঁচার মোক্ষম কৌশল।

একদিন আমাদের গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনী এসেছিল। সেদিনটা আমাদের গ্রামের জন্য ভয়াবহ ছিল। ওরা অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অনেক মানুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে, লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল। আমাদের গ্রামের অনেক নারীদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদের আর কোনো খোঁজ মিলছিল না। বাবা তখনও মুক্তিযুদ্ধের খাতায় নাম লেখাননি। বাবা প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু মা তাকে ছাড়তেন না। বাবা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা বললেই মা কান্নাজুড়ে দিতেন। কিন্তু বাবা ভাবতেন, 'আমি যদি শুধু একজন নারীর কান্না থামাতে মুক্তিযুদ্ধে না যাই, তাহলে সমগ্র দেশে হাজার হাজার মানুষ কাঁদছে, তাদের কান্না কে থামাবে?'

তারপর বাবা আর মায়ের অনুরোধ মানেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পর বাবা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তবে বেশি দূরে যাননি। নিজ জেলা সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন। তাই প্রতিরাতে বাবা বাড়িতে আসতেন। মা ও আমি বাতি জ্বালিয়ে রাত জেগে থাকতাম। মা বাবাকে এক থালাভর্তি ভাত খেতে দিয়ে প্রশ্ন করতেন, 'আজ ক'জন শত্রম্নকে মারলে?' বাবা গর্ব করে বলতেন, 'তিনজনকে মেরেছি, দশজনকে মেরেছি।' মা মোনাজাত ধরে দোয়া করতেন। বাবার মাথায় সরিষার তেল দিয়ে দিতেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাবা ঘুমিয়ে পড়তেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাবাকে সকালে আগের মতো দেখতে পেতাম না। কখন যে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে চলে যেতেন আমি জানতেই পারতাম না। মাকে বলতাম, 'চলো না মা আমরা একদিন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প দেখে আসি।' মা আমাকে ধমক দিয়ে বলতেন, 'মরার বুঝি সাধ হয়েছে?' আমি মাকে বলতাম, 'বাবা তো রোজ ক্যাম্পে যায়, তবুও তো বাবাকে কেউ মারে না? আমাকে কেন মারবে?' এমন কথা বলায় মা আমাকে সেদিন খুব মেরেছিলেন। মাটির গুহার নিচে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কান্নার আওয়াজ বাইরে বের হতে পারেনি। তাই কেউ জানতেও পারেনি।

আমরা প্রায় ইতোমধ্যে সাত মাসের মতো মাটির নিচে বাস করে ফেলি। দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তার মধ্যে বাবা একদিন রাতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। অঝরে রক্ত ঝরছিল। মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। বাবা অসুস্থ হয়েও মাকে সান্ত্বনা দিতেন। বাবা প্রায় মাসখানেক বিছানায় পড়ে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পেরে ভীষণ আপসোস করেন। বাবার বিশ্বাস ছিল, এত দিন যেহেতু শত্রম্নদের মোকাবেলা করেছে আর ক'টা দিন মুক্তিযুদ্ধ করতে পারলে দেশটাকে শত্রম্নমুক্ত করা যেত।

বাবার বিশ্বাস পূর্ণতা পায়। বাবা একদিন শুনতে পায়, বাবা যে সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, সেটি বিজয় ঘোষিত হয়েছে। বাবা সেদিন খুব আনন্দিত ছিলেন। বাবা বলতেন, 'দিন যাচ্ছে আর মনে হচ্ছে আমরা স্বাধীন হচ্ছি।' আমি কিছুই বুঝতাম না বাবার কথা। শুধু তার দিকে চেয়ে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ শেষের দিকে বাবা একেবারে সুস্থ হয়ে ওঠেন। গুলির ক্ষত শুকিয়ে যায়। তখন বাবা আমাকে বলতেন, তারা কীভাবে শত্রম্নদের গুলি করতেন। আমি সে সব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। চোখে না দেখেও উপলব্ধি করতাম। বাবা আমাকে একদিন পিস্তল দেখিয়ে ছিলেন। তারপর আমি দু'দিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। মা তো বাবার ওপর ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন।

একদিন দুপুরবেলা বাবা রেযিওতে খবর শুনছিলেন। হঠাৎ আনন্দের খবর ভেসে এলো যে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়েছে। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর। বাবা আমাদের নিয়ে চিৎকার দিয়ে মাটির গুহা থেকে বের হলেন। আমরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দেখলাম, গ্রামটা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সবুজ গাছপালা নেই, ঘরবাড়ি নেই। ধু-ধু প্রান্তর। শুধু কালো কালো ছাই বাতাসে উড়ছে। নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। বাবা সবাইকে চিৎকার দিয়ে বললেন, 'আজ থেকে তোমাদের কারও আর ভয় নেই। আমরা স্বাধীন হয়েছি। যুদ্ধে জয় লাভ করেছি।' বাবার সেদিনের বিজয় উলস্নাসের কথা আমার এখনো মনে পড়ে। বাবা এখন পৃথিবীতে নেই। আমিই বাবার বয়সী হয়ে গেছি। বাবাকে এখন খুব মনে পড়ে।

প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস এলে বাবার কথা বেশি মনে পড়ে। জিতু তার বাবাকে প্রশ্ন করে, 'বাবা, দাদুদের স্মরণ করতেই কি প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়?' বাবা জিতুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, 'তুমি ঠিকই বুঝতে পেরেছ। তোমার দাদু মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় দশ বছর জীবিত ছিলেন। কত রেডিও, টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তার কাছে সাক্ষাৎকার নিতে আসতেন। আমি তখন সব বুঝতাম। বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম। বাবা যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হয়েছিল। তোমার দাদুর উপাধি ছিল 'বীরপ্রতীক'।

জিতু তার বাবাকে বলে, বাবা তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোক। বাবা বলেন, 'হঁ্যা আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোক। আমরা এটি নিয়ে গর্ববোধ করি।' জিতু তার বাবাকে বলে, 'সত্যই বাবা দাদুর মতো অনেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন বলে আমরা স্বাধীন দেশটা পেয়েছি। স্বাধীনতা দিবসে তাদের স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য।'

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42680 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1