দ্বীপসম এক গঁায়ে এসে পেঁৗছলেন তিনি। সময়টা দুপুরের কাছাকাছি। একটা গাছের নিচে দঁাড়ালেন। প্রচÐ রোদ ছিল তখন। তপ্ত হাওয়া বইছে। গাছের ছায়াটিও যেন গরমে ভাপানো। ঝুলি সদৃশ্য ব্যাগ থেকে একটা কাপড় বের করে মুছে নিলেন মুখ। তারপর ওই কাপড় দিয়েই বাতাস করতে লাগলেন নিজের শরীরে। বেশকিছু ছেলেমেয়ে জুটেছে তাকে ঘিরে কৌত‚হলী দৃষ্টিতে। তাদের কেউ কেউ তাকে হ্যামিলনের বঁাশিওয়ালা কিংবা গালিভার ভাবছে। কজন বড়ও এসে জুটলো। আরও আসছে...। তারা কেউ হাসছে, কেউ সকৌতুকে চেয়ে আছে, কেউ কেউ ফিসফঁাস করছে। লোকটি ব্যাগ থেকে ইয়া বড় একটা বেলুনের মতো বোতল বের করে রঙিন পানি ঢক ঢক করে খেল। তবে যখন ওটি বের করছিল দঁাড়ানো সবাই দারুণ কৌত‚হলে তাকাচ্ছিল ওটির দিকে। কেননা তারা মনে করছে, বঁাশি বা অন্য কিছু বের করবেন!
হঠাৎ চঞ্চলতা বেড়ে গেল তাকে ঘিরে দঁাড়ানো জটলাটার মধ্যে। লোকটি বুঝে ফেলার আগেই ছোটাছুটি শুরু হলো। এ ওকে কেউ কেউ কিছু বলছে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে, কেউ কেউ নিদের্শনা দিচ্ছে, কেউ কেউ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, কেউ শুধু ভাবছে।
তবে সবাই প্রায় কী যেন খঁুজছে যে যার ভঙ্গিতে। লোকটি কাকে কী বলবে ফুসরত পেল না। তিনি বসে পড়লেন। গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলেন। তবে জানতে তার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, ব্যাপারখানা!
হন্তদন্ত হয়ে অন্বেষণে ব্যস্তরা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। গঁায়ের মুরব্বিরা চিন্তাযুক্ত হয়ে কিছু বোঝার চেষ্টায় রইল। তবে অন্বেষণ দলের যুবক শ্রেণির কেউ কেউ তখনও তারুণ্যের চোখে খঁুজছে। আর ছেলেমেয়েরা কৌত‚হলী চোখে তাকিয়ে আছে কেউ কেউ। কেউবা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তবে সবাই এক সময়ে ঘুমে ঢলে পড়ল, যে যেখানে বসেছিল।
কিন্তু লোকটির ঘুম আসছিল না। সে ভাবছিল ব্যাপারখানা নিয়ে।
এক সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। কেউ কেউ জেগে উঠছে। এর মধ্যে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠলÑ ওই তো ছায়া! সঙ্গে অন্যরাও সেদিকে লক্ষ্য করল। চোখ ঘষে আবারও দেখল, আবারওÑ। বিশ্বাস হওয়ার জন্য কেউ কেউ নড়েচড়ে পরীক্ষা করল। চিৎকার করে উঠল কেউ কেউ বিজয়ীর বেশে। যারা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল, তারা অঁাৎকে উঠে ঠাওর করতে পারছিল না বিষয়টা! কিছুক্ষণ নিবির্কার রইল। একটি ছেলে বোবার মতো বসে রইল, যেন সে এ জগতে নেই। বেশ চাঞ্চল্যকর অবস্থা সৃষ্টি হলো। সবাই সবার নিজের ছায়া, অন্যের ছায়া বারবার যেন নতুন করে দেখে নিতে লাগল। আনন্দে আনন্দে অনেকেই জমা হতে থাকলো লোকটির কাছে। কেউ একজন বললÑ লোকটিকে তো ম্যাজিসিয়ানের মতো লাগছে! ব্যাপারটি হয়তো উনি বলতে পারবে। শুনে সঙ্গে সঙ্গেই আরেক জন বলল, ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ! গলা খঁাকারি দিয়ে বলার প্রস্তুতি নিল সে। কিন্তু কী হতে কী হয় এমন ভেবে দমে গেল। লোকটি অঁাচ করতে পেরে ওর দিকে তাকালো পরখ করার মতো। জিজ্ঞাসু লোকটি একটু ভড়কে গেল। অন্যদিকে তাকানোর ভঙ্গি করল সে। মনে হয়, সে যেন কিছ্ইু জানে না।
নতুন লোকটি বললÑ এই যে ভায়া, কিছু বলবেন? লোকটি ফুসফাস করে পাশের জনকে বলল, বললাম না জ্যোতিষী-টোতিষী হবে! পাশের জন নতুন লোকটির পানে বঁাকা চোখে তাকিয়ে বলল, তাইতো! নতুন লোকটি বললÑ দেখছেন কী! বলুন। বলুনÑ, যা বলতে চাইছেনÑ
কিছু না বলে প্রশ্নকারী লোকটি হন হন করে জটলা থেকে বেরিয়ে গ্রাম প্রধানের কাছে গেল। তার কাছে অনুমতি নিল এবং ফিরে এলো। এসে ঢোক গিলে কঁাপা কঁাপা কণ্ঠে বলল, গ্রামপ্রধান আপনাকে ডাকছে।
এদিকে একটা বই পড়া শুরু করেছেন তিনি। তবে তা মানচিত্রজাতীয় বই। শুনে না বুঝতে পেরে তিনি বললেন, কিছু বলছেন?
যেন ভরকে গেল লোকটি। সে কিছু বলতে পারল না। পাশের জনই বলল, গ্রামপ্রধান আপনাকে দেখা করতে বলছেন। আবারও গলা খঁাকারি দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলল, এখানকার এই নিয়ম। নতুন কেউ এলে গ্রামপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে হয়।
ওÑ তাই! এই বলে লোকটি তৎক্ষণাৎ পোটলা গুটিয়ে চলল গ্রামপ্রধানের কাছে।
যাহোক, গ্রামপ্রধানই প্রসঙ্গটা উঠালো যে, তাদের ছায়া হারিয়েছিল কেন?
হোÑ হোÑ হোÑ করে হাসল লোকটি শুনে। যারা ছিল তারা কৌত‚হলী দৃষ্টিতে দেখছিল তাকে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেও দেখাদেখি করল!
এদিকে লোকটি হাসি থামাতে পারছিলেন না বোধ হয়। এ নিয়েও সবার মধ্যে আবারও চঞ্চলতার সৃষ্টি হলো।
এক সময় লোকটি উঠে দঁাড়ালেন। চলে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে বললেনÑ তখন কী আকাশে মেঘ ছিল! আবারও হাসিÑ হোÑ হোÑ হো...