শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

সোনার ময়না

সঞ্জয় কর
  ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

চোখ কচলাতে কচলাতে জানালার পাশে দঁাড়ায় আরফা। জানালা খোলে বাহিরে তাকায় সে।

ফুর-ফুরে হাওয়া বইছে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। মনে হচ্ছে মহল্লার সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রমজান মাসের ভোর বেলা এরকমই হয়। এটা আরফার জানা। সারা রাত জুড়ে মহল্লায় চলে নানা হই হোল্লোড়। কেউবা খেলাধুলা করেন। কেউবা কোরআন তেলাওয়াত করেন। কেউবা সেহরির জন্য বাহারি খাবার তৈরিতে রাত কাটিয়ে দেন। সেহরির পর রাত জাগা মানুষগুলো ক্লান্ত দেহে হেলে পড়ে ভোরের শরীরে।

আরফার দীঘির্দনের অভ্যাস ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। সারা রাত জাগলেও ভোর বেলা দুচোখের পাতা এক হবে না তার। হঠাৎ আরফার চোখ পড়ে শশী আপাদের বাসার দিকে। জানালার গ্রিল ধরে একটি মেয়ে দঁাড়িয়ে আছে। একে তো আর কোনদিন দেখেনি সে! মুখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকায় আরফা। মেয়েটিও হাসি মুখে তার দিকে তাকায়। আরফা ও শশী আপাদের বাসা পাশাপাশি। আরফার শোয়ার ঘরের জানালা বরাবর একটু দূরেই শশী আপাদের ঘরের একটি জানালায় দঁাড়িয়ে আছে শ্যামল বরণ মেয়েটি। গায়ে আকাশি রঙের জামা। মাথার এলোমেলো চুলগুলো ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। আরফা বলে তোমার নাম কী?

- সোনা

- এটা আবার কেমন নাম!

- আসলে আমার নাম সোনালি। বাবা মা আদর করে ডাকতেন সোনা।

আরফা এবার কৌত‚হলী দৃষ্টিতে সোনার দিকে তাকিয়ে বলে, বেড়াতে এসেছ বুঝি?

সোনা আট-দশটা মেয়ের চেয়ে একটু ভিন্ন। খুব বুদ্ধিমতি তবে শান্তস্বভাবের। কারও চোখেমুখে কৌত‚হলের একটু রেশ পেলেই হলো। সে তাকে আরও কৌত‚হলী করে তোলবে। কৌত‚হলের মূল রহস্য জানা থাকলে সহজে তা প্রকাশ করবে না। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই সে এরকম। সুবোধ বালিকা সোনার এই একটাই দোষ। ঘি এর মধ্যে এই একটাই কঁাটা। এর জন্য বাবা মা তাকে কত্তো গালমন্দ করতেন। তা এখনো মনে পড়ে সোনার।

রহস্যময় হাসি হেসে সোনা বলে কী মনে হয় তোমার?

- মেহমান।

- না।

- তাহলে বলো কে তুমি?

- না, বলব না।

সোনা জানালার গ্রিল ছেড়ে ঘুরে দঁাড়ায়। আরফা ডাকে কিন্তু সে শুনে না। আরফা মনে মনে হিসেব কষে মেহমান না হলে আর কি হবে? নিশ্চয় শশী আপাদের কাজের মেয়ে। এ বাড়িতে কাজের মেয়েরা বেশি দিন থাকে না। কিছু দিন থেকেই কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে চলে যায়। কিন্তু সোনার মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি আরফার মনে হয়, এই মেয়েটি দীঘির্দন থাকবে এ বাড়িতে। এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটি কোনো অঘটন ঘটাতে পারেই না।

আজ আরফা রোজা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সূযর্টা সবে মাত্র মাথার ওপর উঠেছে। ইফতারের এখনো আরো অনেক সময় বাকি। প্রচÐ রোদ। পানি পিপাসায় বুক যেন ফেটে যাচ্ছে তার। ধীরে ধীরে জানালার পাশে যায় সে। গ্রিলের ওপর মাথা ঠেকিয়ে দঁাড়িয়ে থাকে। সোনার কাশির শব্দে মাথা তুলে আরফা। সোনাকে দেখেই সে এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে, “আমি জানি, তুমি এ বাড়িতে কাজ করতে এসেছো, আর এটাও জানি তুমি দীঘির্দন এখানে থাকবে, তুমি খুব ভালো মেয়ে।”

সোনার মুখে এখন আর রহস্যময় হাসি নেই। মুহ‚তের্ই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন কাজ আর কাজ, তার ভালো লাগে না। গঁায়ের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এ বাড়িতেই থাকতে হবে তাকে। মা মারা গেলেন অসুস্থ হয়ে আর বাবা বাধর্ক্যজনিত কারণে। কে তাকে খাবার দেবে? কে তাকে কাপড় দেবে? গ্রাম সম্পকির্ত এক চাচার হাত ধরেই তার এ বাড়িতে আসা।

আরফা বলে “কি হলো, সোনা কথা বলছো না যে?”

- এমনি

- তোমার মা বাবা নিশ্চই বাড়িতে আছেন।

- না। এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেউ নেই, শুধু ময়না ছাড়া। ময়নাকে ছাড়া আমি একদিনও থাকতে পারি না। তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।

- ময়না কে?

- আমার বোন।

- তোমার বোনকে তো দেখলাম না!

এতক্ষণে মনের সব দুঃখ ঝেড়ে ফেলে দেয় সোনা। আবার সেই রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। সোনা বলে “আমার বোনতো আর কাঠের পুতুল না যে, বললেই তোমাকে এনে দেখাব।” কথাটি বলেই ঘোরে দঁাড়ায় সে।

প্রতিদিনই আরফা ও সোনার কথাবাতার্ হয়। ইতোমধ্যেই তারা একে অপরের সম্বন্ধে অনেক কিছুই জেনেছে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু সোনার বোন ময়নার রহস্যের জট এখনো খোলেনি। ময়নার কথা আসলেই এড়িয়ে যায় সোনা। সোনাকে বেশ ভালো করেই চিনে ফেলেছে আরফা। সে জানে এই মেয়েটি তার বোনকে দেখাবে না। নিজেই দেখে নিতে হবে। আরফা সবসময় দৃষ্টি রাখে শশী আপাদের বাসার দিকে। ছাদে উঠলে আপাদের বেলকনি স্পষ্ট দেখা যায়। মাঝেমধ্যে ছাদে উঠে আরফা। কিন্তু আর কোনো নতুন মানুষকে দেখতে পায় না সে।

আরফার বাবা, মা সরকারি চাকরি করেন। দুজনেই সকাল বেলা বাসা থেকে বের হন আর বিকেল বেলা বাড়ি ফেরেন। দাদিমার সঙ্গেই সারাদিন কাটে আরফার। দাদিমা কিছুটা অসুস্থ। আরফা সিদ্ধান্ত নেয়, দাদিমা সুস্থ হলেই শশী আপাদের বাসায় তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। তখন সোনা আর কোথায় লুকাবে ময়নাকে। একথা ভাবতেই আরফার মনে আনন্দ দোলা দিয়ে যায়। নিজের অজান্তেই হেসে ওঠে সে।

দেখতে দেখতে রমজান মাস চলে গেল। আজ ঈদ চারিদিকে উৎসবমুখর ভাব। পাড়ার ছেলেরা রাস্তায় ‘ঈদ মোবারক’ লিখে গেট দিয়েছে। সামনের মাঠে বিকেল বেলা কনসাটর্ হবে। দেশের নামি-দামি শিল্পীরা গান গাইবেন। এর জন্য স্টেজ সাজানোর কাজ চলছে। আরফা গোসল সেরে নতুন জামাকাপড় পরে জানালার পাশে দঁাড়িয়ে এসব দেখছিল। হঠাৎ সোনার ডাক শুনে চমকে ওঠে সে। সোনা হাসি মুখে বলে এই দেখ আমার ঈদের জামা। বেগম সাহেবা দিয়েছেন। খুব সুন্দর না জামাটা?

আরফার মুখ থেকে গুলির মতো একটি কথা বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু তা হতে দিল না সে। দুই ঠেঁাট চেপে ধরলো আরফা। কথাটি বলে সোনার আনন্দ নষ্ট করতে চায় না সে। আরফা ভালো করে জানে, সোনা যে জামাটি নতুন ঈদের জামা মনে করছে, এটি শশী আপার বেশ পুরনো একটি জামা। নিজেকে সামলে নিয়ে আরফা বলে, হ্যঁা, খুব সুন্দর জামা।

আরফা দাদিমার সঙ্গে ওই বিষয়টি আলোচনা করে। দাদিমা বলেন, “আনন্দটা নিভর্র করে সন্তুষ্টির ওপর, পুরাতন জামাটিকে নতুন মনে করে সোনা সন্তুষ্ট হয়েছে, তাই সে আনন্দ পাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন “পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আমাদের যখন যে অবস্থায়ই রাখেন, আমরা যদি তা মেনে নেই, এতে যদি আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি তাহলে কোনো দুঃখ-কষ্টই আমাদের স্পশর্ করতে পারবে না।” দাদিমার কথাগুলো মনে গেঁথে রাখে আরফা। দাদিমা সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। বিকাল বেলা আরফা সোনাকে না জানিয়েই দাদিমাকে নিয়ে শশী আপাদের বাসায় হাজির হলো। বারান্দায় পা রাখতেই উপরে ঝুলানো খঁাচায় বন্দি ময়না পাখিটা বলল “বড় আপা, বড় আপা মেহমান এসেছেন।” ময়নার কণ্ঠ শুনে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে সোনা। আরফা বুঝতে পারল এই কালো ময়না পাখিটাকেই সোনা বোনের মতো ভালোবাসে। আরফার মুখে সফলতার হাসি ফোটে ওঠে। সোনার কানে কানে আরফা বলে, “এই ময়না পাখিটাই বুঝি তোমার বোন।” সোনা কোনো কথা বলে না, নীরবে দঁাড়িয়ে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<34446 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1