বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বইয়ের ঘ্রাণ

গল্প
আরাফাত শাহীন
  ১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মায়মুনার স্কুলে আজ নতুন বই দেয়া হবে।

কদিন আগেই মায়মুনা তার বাবার সঙ্গে গিয়ে স্কুলে ভতির্ হয়ে এসেছে। মোজাম্মেল হোসেন মেয়ের ছোট্ট নরম হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মায়মুনার সে কী লজ্জা! পারলে লজ্জায় সে মাটির সঙ্গেই মিশে যেত। বাবা বলেন, ‘শোনো, তোমাকে এতটা লজ্জা পেলে কিছুতেই চলবে না। এমন করলে সবার সঙ্গে মিশবে কীভাবে? শিক্ষকের কাছে অজানা প্রশ্নগুলো যদি করতে না পারো তাহলে জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে কীভাবে?’

মায়মুনা তবুও কোনো কথা বলে না। তার লজ্জা যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। মোজাম্মেল হোসেন মনে মনে হাসেন। ছোটবেলায় তিনিও এমন ছিলেন। লজ্জায় কারও সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না, বন্ধুদের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতেও পারতেন না। সবাই তাকে নিয়ে বেজায় হাসাহাসি করত। লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে যেত তার চেহারা। তিনি মায়মুনাকে বলেন, ‘তোমার মতো আমারও ছোটবেলায় প্রচÐ লজ্জা ছিল। জানো, স্কুলে প্রথম দিন কী হয়েছিল?’

মায়মুনা আব্বুর মুখের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘কী হয়েছিল?’

‘এই তো আমার মামণির মুখে কথা ফুটেছে। এভাবে কথা বলতে হবে। মনে কোনো প্রশ্ন জেগে উঠলে সেটা জমিয়ে না রেখে করে ফেলতে হবে।’

বাবার মুখে হাসির রেখা দেখে মায়মুনাও হেসে দেয়। সে লাজুক হলেও বেশ বুদ্ধিমতি। সহজেই সবকিছু বুঝে নিতে পারে।

আব্বু বলে চলেন, ‘প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম ক্লাসে শিক্ষক আমাকে এসে প্রশ্ন করলেন, তোমার নাম কী বাবু? আমার ভীষণ লজ্জা করছিল। জীবনে প্রথম সেদিন স্যারকে দেখেছি। তার সামনে কীভাবে কথা বলব কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।’

‘কেন? এমন সহজ প্রশ্নের জবাব তুমি দিতে পারোনি আব্বু?’

‘খুব সহজ প্রশ্ন তাই না?’

‘অবশ্যই সহজ প্রশ্ন। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে চোখ বন্ধ করে বলে দিতাম, মায়মুনা মুসতারি।’

‘মেয়ের এমন চটপটে জবাব শুনে মোজাম্মেল হোসেন হেসে ফেলেন। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘শোনো, মানুষের মধ্যে অবশ্যই লজ্জা নামক বিষয়টা থাকা উচিত। কারণ জীবন চলার পথে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে আমাদের সবার জানা উচিত কোথায় লজ্জার প্রয়োগ করতে হবে।’

‘আচ্ছা আব্বু, আমি আমার শিক্ষককে কী বলে ডাকবো?’

‘বুদ্ধিমতির মতো প্রশ্ন করেছো। তাদের সাধারণত স্যার বলেই ডাকা হয়। তবে শিক্ষিকাকে ডাকা হয় ম্যাডাম বলে। মনে থাকবে?’

‘জি আব্বু, থাকবে।’

স্কুলে সেদিন বেশিক্ষণ থাকা হয়নি। ভতির্ হয়েই তারা বাড়িতে ফিরে এসেছিল। ফেরার পথে আব্বু শিক্ষকদের সামনে লজ্জা না করার জন্য বারবার বলে দিয়েছেন। মায়মুনা তার আব্বুকে অভয় দিয়ে বলেছে, ‘তুমিও আমার কাছে যেমন তারাও তেমনি। আমি অবশ্যই আমার শিক্ষকদের সামনে গিয়ে লজ্জা পাবো না।’

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘এই তো আমার ল²ী সোনা।’

মায়মুনার স্কুলের নাম ফুলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার গ্রামে স্কুল এই একটাই। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে হলেও মায়মুনার তাতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না। আব্বু প্রতিদিন এই পথ দিয়ে অফিসে যান। তার সঙ্গে সে সহজেই চলে আসতে পারবে। তা ছাড়া তাদের পাড়ার অনেকেই দল বেঁধে স্কুলে যায়। তাদের সঙ্গেও মায়মুনা যেতে পারবে।

স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে মায়মুনা দেখতে পেল স্কুলমাঠের এক অংশে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সেখানে তার মতো অসংখ্য শিক্ষাথীর্ বসে আছে। সবাই আজ নতুন বই নিতে এসেছে। তাদের কারও কারও পাশে আব্বু অথবা আম্মু বসে আছেন। আবার যারা একটু বড় ক্লাসে পড়ে তারা একাই এসেছে। স্কুলে ভতির্র দিনের মতো আজও মোজাম্মেল হোসেন মেয়ের সঙ্গে এসেছেন। এই স্কুলের সঙ্গে তার নাড়ির বন্ধন। এখানেই যে তিনি তার শৈশবের পঁাচটি বছর পড়াশোনা করেছেন!

স্কুলের পাশ দিয়েই বেশ বড় একটা খাল প্রবাহিত হয়েছে; অনেকটা নদীর মতোই। মোজাম্মেল হোসেনরা যখন এখানে পড়তেন তখন খালের পাশেই বিশাল একটা বটগাছ ছিল। বটগাছের গোড়ায় গিয়ে তারা বসতেন। এখন আর সেই বটগাছটি নেই। অনেক আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। আজ মেয়ের সঙ্গে স্কুলে এসে হঠাৎ করেই মোজাম্মেল হোসেনের পুরনো দিনের সেসব কথা মনে পড়ে গেল।

মায়মুনা আব্বুর সঙ্গে গিয়ে একটা খালি বেঞ্চে বসল। তার আশপাশে তার মতো আরও অনেকেই চুপচাপ বসে আছে। হেডস্যার এসে পৌঁছালে সবাই তার সম্মানে দঁাড়িয়ে পড়ল। আব্বুর সঙ্গে সঙ্গে মায়মুনাও দঁাড়ালো। আব্বুকে কানে কানে সে প্রশ্ন করল, ‘সবাই এখন দঁাড়িয়ে গেল কেন?’

‘যখন কোনো সম্মানিত ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন তখন তার সম্মানে দঁাড়িয়ে যেতে হয়। এটাই নিয়ম।’

‘ক্লাসে শিক্ষক যখন এসে প্রবেশ করবেন তখনও কি এভাবে দঁাড়িয়ে যেতে হবে?’

‘অবশ্যই তখন দঁাড়িয়ে যাবে এবং তাকে সালাম প্রদান করবে।’

মায়মুনা মাথা নেড়ে সায় দিল। সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।

হেডস্যার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি কেউ বলতে পারো আজ আমরা এখানে এসে কেন মিলিত হয়েছি?’

ক্লাস ফোরের একটা ছেলে উঠে জবাব দিল, ‘আমাদের আজ নতুন বই দেয়া হবে।’

স্যার তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘হ্যঁা। আজ বছরের প্রথম দিন। সারা দেশে পালিত হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক উৎসব। এদিন দেশের সব স্কুলে শিক্ষাথীের্দর মধ্যে নতুন বই বিতরণ করা হচ্ছে।’

‘স্যার, আপনাদের সময়ও কি এভাবে উৎসব করে বই বিতরণ করা হতো?’

স্যারের কথা শেষ হতেই মায়মুনা উঠে দঁাড়িয়ে প্রশ্ন করল। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকালো। মোজাম্মেল হোসেন নিজেও বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছেন। মায়মুনা এমন সুন্দরভাবে গুছিয়ে প্রশ্ন করতে পারল!

হেডস্যারের মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বসতে গিয়েও আবার দঁাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম কী সোনা?’

‘মায়মুনা মুসতারি।’

একেবারে স্পষ্ট জবাব। স্যার খুশি হলেন। তারপর বললেন, ‘এবার নতুন ভতির্ হয়েছো বুঝি?’

‘জি স্যার।’

‘শোনো, আমাদের সময়ও নতুন বই দেয়া হতো। তবে এমন ঘটা করে উৎসবমুখর পরিবেশে নয়। আবার অনেক সময় বড়দের পুরনো বইও পড়তে হতো। তবে তোমরা সৌভাগ্যবান। এমন উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই।’

হেডস্যার সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছোট্ট মেয়েটি প্রথম দিনেই আমাকে এমন একটা প্রশ্ন করে চমকে দিয়েছে। আমি ওর প্রতি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। তাই আমি তার হাতে প্রথমে বই তুলে দিয়ে আজকের বই উৎসবের সূচনা করতে চাই।’

সবাই সমস্বরে বলল, ‘হ্যঁা তাই হোক।’

হেডস্যার মায়মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মামনি তুমি এখানে চলে এসো।’

মায়মুনা আব্বুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। মোজাম্মেল হোসেনও মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিলেন। মায়মুনা মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।

হেডস্যার নিজহাতে মায়মুনার হাতে বই তুলে দিলেন। তার হাতে বই দেয়ার সময় কয়েকটি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল। বই হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে দঁাড়িয়ে রইল। তার খুব ভালো লাগছে। ভাগ্যিস সাহস করে দঁাড়িয়ে প্রশ্নটা সে স্যারকে করেছিল!

নতুন বই পেয়ে মায়মুনা তো মহাখুশি। কী সুন্দর ছবিওয়ালা বই। দেখেই মন ভরে যায়। মায়মুনা নাকের কাছে নিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ উপভোগ করল। আহ! প্রাণটা বুঝি জুড়িয়ে গেল! তারপর আব্বুর হাতে বইগুলো দিয়ে বলল, ‘আব্বু শুঁকে দেখো কত সুন্দর ঘ্রাণ!’

মোজাম্মেল হোসেন বইগুলো নাকের কাছে ধরলেন। বহুক্ষণ তিনি চোখ বুজে রইলেন। তার বুকটা জুড়িয়ে গেল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় নতুন বই হাতে পেলে আমি এভাবে ঘ্রাণ উপভোগ করতাম। নতুন বইয়ের ঘ্রাণের মতো কোনোকিছুই আমি আর পাইনি।’

‘আমার কাছেও সবচেয়ে সুন্দর।’

মায়মুনা বলল।

‘এভাবে সারাজীবন যদি বইয়ের সঙ্গে মিশে থাকতে পারো তাহলে জীবনটা সুন্দরে পরিপূণর্ হয়ে উঠবে।’

মোজাম্মেল হোসেন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<32287 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1