শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের গল্প

রুহুল আমিন রাকিব
  ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতেও বাবা-মায়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে রাশেদ ও দিহান।

হঠাৎ মানুষের চিৎকারের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙে ওদের। রাশেদের বাবার একটুও বুঝতে বাকি থাকে না পাকিস্তানি সেনারা আর বাংলার রাজাকাররা ওদের গ্রামে আক্রমণ করছে। রাশেদ ও দিহান তখন অনেক ছোট্ট, রাশেদের বয়স মাত্র পঁাচ, আর দিহানের তিন বছর। রাতের অঁাধারে ওদের নিয়ে কী করবে কিছুই ভেবে পায় না দিহানের বাবা-মা! হঠাৎ ঘরের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজের শব্দ শুনে ভয় পেয়ে যায় দিহানের আম্মু। কে যেন বাহির থেকে দরজা খুলে দিতে বলল। দিহানের আম্মু অনেক মানা করা সত্তে¡ও দরজা খুলে দিল দিহানের বাবা।

দিহানও রাশেদকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দিহানের আম্মু মনে মনে আল্লাহর নাম জপে!

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ওদের ঘরে ঢুকে পড়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার।

ওদের ঘরের সব কিছু লÐভÐ করে দিয়ে টাকা-পয়সা ও দামি দামি আসবাবপত্র সব কিছু লুট করে নেয়। দিহানের আব্বু-আম্মু প্রতিবাদ করতে গেলে, দিহানের বাবাকে তিনজন পাক-সেনা ও রাজাকার মিলে হাত-পা বেঁধে ফেলে, চোখও বেঁধে ফেলে কালো কাপড় দিয়ে। ওদের সামনে হাসতে হাসতে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় রাজাকারদের কেউ একজন।

দিহানও রাশেদকে এক রকম টেনেহিঁচড়ে ওদের মায়ের বুক থেকে আলাদা করে নেয়।

ওদের আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে যায় বাংলার আকাশ! দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে দিহানদের থাকার ঘর।

ওরা ভালো করে তাকিয়ে দেখে, শুধু ওদের ঘর নয়, পুরো গ্রামটা যেন আগুনের কুÐলী। চতুদিের্ক শুধু আগুন আর আগুন। মানুষের আহাজারি আর চিৎকার ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

ওদের গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ একটুও প্রস্তুত ছিল না এমন ভয়ঙ্কর একটা রাতের জন্য।

সেদিন রাতের অঁাধারে অনেক ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারছে পাকিস্তানিরা। হাত-পা বেঁধে পাখির মতো করে গুলি করে মারছে অনেক মানুষকে।

মায়ের সামনে, মেয়েকে, ছেলের সামনে মাকে, ধষর্ণ করতেও বাদ রাখে নাই ওই মানুষরুপি পাকিস্তানি হায়নারা, ওদের সঙ্গে কিছু বিপথগামী বাঙালি রাজাকাররাও মেতে ওঠে বুনো উল্লাসে! সেদিনের কালো রাতে কিছুই করার ছিল না, দিহান ও রাশেদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া।

ওদের সামনে ওদের মাকে ও ধষর্ণ করে হায়নার দলেরা। দিহানের বাবা প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে বুক ঝাররা করে দেয় ওদের সামনে। ছোট্ট দিহান ও রাশেদ কিছুই করতে পারে নাই সেদিন ওদের বিরুদ্ধে অশ্রæ ভেজা চোখে বাবার মৃত্যু দেখা ছাড়া! দিহানের বাবার লাল লাল তাজা রক্ত ভিজে যায় বাংলার মাটি।

সেদিন রাতের অঁাধারে এমনি করে অনেক জনকে গুলি করে মেরে ফেলে লাশগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা।

দেখতে দেখতে এক সময় ভোর হয়ে যায়! পুবের কোণে খেলা করে লাল রবি।

ওরা তাকিয়ে দেখে ওদের গ্রাম যেন একটা শ্মাশান...

কোথাও কোনো বাড়িঘর নেই, যেদিকে চোখ যায় তাকিয়ে দেখে শুধু ধেঁায়া উড়ছে। আকাশে-বাতাসে ভাসছে শুধুই মানুষ পোড়ার গন্ধ!

সেদিন সূযর্ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে যেভাবে পারে ওদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় অন্য কোথাও।

দিহান ও রাশেদকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিনের পর দিন জঙ্গলে পালিয়ে থাকে ওদের আম্মু।

কয়েক দিন এমন করে পালিয়ে থাকার পরে ওদের দূর সম্পকের্র এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে ঠঁাই নেয়।

শত কষ্ট আর মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়েও এই দেশ ছেড়ে চলে যায়নি ওরা। দিহানের আম্মু সব সময় স্বপ্ন দেখতো একদিন এই দেশ স্বাধীন হবে! শান্তিতে চলাফেরা করতে পারবে সবাই।

ভাই-বোন, স্বামী আর বাবা-মা হারা, সবাই স্বপ্ন দেখতো লাখো লাখো শহীদের রক্ত আর মা-বোনের ইজ্জতের মূল্য কখনই বৃথা যেতে পারে না।

একদিন এই বাংলার আকাশে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা! পাখির কলতানে ঘুম ভাঙবে সবার।

মসজিদ থেকে ভেসে আসবে আজানের সুর!

ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে বই হাতে স্কুলে যাবে!

নতুন করে সবাই জানবে এই দেশের ইতিহাস, বিশ্ব মানচিত্রে ভেসে উঠবে নতুন একটি স্বাধীন দেশের নাম। দিহানের আম্মুর সেই অপেক্ষার অবসান হতে বেশিদিন সময় লাগে না, হঠাৎ একদিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় মানুষের মুখরিত কণ্ঠ আর জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু মিছিলের সুর শুনে! মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে ফজরের আজান! দিহান ও রাশেদ ঘরের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখে, রাস্তাজুড়ে শত শত মানুষের ভিড়, ওরা দৌড়ে গিয়ে হারিয়ে যায় সেই উতাল মানুষের সাগরে! দিহানের আম্মুও যোগ দেয় ওদের সঙ্গে, পুবের কোণে রক্ত লালে হেসে ওঠে সূযির্্য মামা।

আকাশ পানে উড়ে চলে মুক্ত ধান শালিকের ঝঁাক!

কে যেন হাজারো মানুষের ভিড়ে উড়িয়ে দেয় সাগর সমান রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল-সবুজের পতাকা!

সেদিনের সেই ছোট্ট রাশেদ ও দিহান, আজ অনেক বড় হয়েছে, স্কুলের বাংলা বই পড়ে জানতে পারে সেদিনের সেই রক্তরাঙা প্রভাত বেলার বিজয় মিছিলের দিনটা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির দিন! নতুন একটা স্বাধীন দেশের জন্মের দিন বাঙালি জাতির গৌরব মহান স্বাধীনতা দিবস।

১৬ ডিসেম্বর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26619 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1