শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ই স লা মী বি শ্ব বি দ্যা ল য় ...

অভিজ্ঞতা অর্জনের ভ্রমণে

মুনজুরুল ইসলাম নাহিদ
  ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে চোখ রাখলাম স্ক্রিনে। সকাল সাড়ে ৭টা। ওপাশ থেকে বন্ধুর কণ্ঠ, 'কিরে উঠিসনি এখনো? দ্রম্নত বেরিয়ে পড়, খুব বেশি সময় নেই?'। ডাটা অন করে ডিপার্টমেন্টের মেসেঞ্জার গ্রম্নপে ঢুকলাম। সবাইকে সাড়ে ৮টার আগেই উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। সাড়ে ৮টায় বাস ছেড়ে যাবে। শীতের সকালে প্রিয় বিছানার উষ্ণ পরশ ছেড়ে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মনে তখন নতুন অভিজ্ঞতা আহরণের চিন্তা। বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। পরীক্ষা শেষে ভাইভাও শেষ করেছি একদিন আগে। বিভাগের পক্ষ থেকে শিল্পকারখানা পরিদর্শনে যেতেই এ প্রস্তুতি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল' অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ যাত্রা। চতুর্থ সেমিস্টারে শ্রম আইন কোর্স পড়ানোর সময় কোর্স শিক্ষক বনানী আফরিন ম্যাম ঘোষণা দিয়েছিলেন পঠিত বিষয়ে সরাসরি জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদের নিয়ে যাবেন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। তারই অংশ হিসেবে বিভাগের সভাপতি ড. সেলিম তোহা স্যারের ব্যবস্থাপনায় আমাদের গন্তব্য কুষ্টিয়া শহরে অবস্থিত বৈদু্যতিক তার উৎপাদনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান শাখায়। পরীক্ষার আগে যাওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা হয়ে ওঠেনি। তবে পরীক্ষা শেষে একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার জন্য এমন একটি আয়োজন খুবই প্রয়োজন ছিল। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন একাডেমিক ভবনের সামনে থেকে গাড়িতে ওঠার সিদ্ধান্ত ছিল। সকাল থেকেই কুষ্টিয়া স-১১০০০ নম্বরের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িটি অপেক্ষায় ছিল আমাদের জন্য। আবাসিক হল ও ঝিনাইদহ শহরে থাকা শিক্ষার্থীরা যাবে ক্যাম্পাস থেকে। আর যারা কুষ্টিয়া শহরে থাকেন তারা যোগ দেবে আমরা পৌঁছলে। আমাদের সার্বিক দিকনির্দেশনায় আছেন বনানী আফরিন ম্যাম। ম্যামও যুক্ত হবেন কুষ্টিয়া থেকে। সবাই উপস্থিত হওয়ার পর ক্যাম্পাস থেকে ছাড়ল আমাদের বাস। সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কে চলতে শুরু করে গাড়ি। গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়, ক্যাম্পাস থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার। অনেকের প্রতিদিনের যাতায়াতের পথ। তবে আজকের যাত্রার আমেজটা পুরো ভিন্ন। সবার বসনে পরিপাটি পোশাক আর মনে নতুন কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা। একঝাঁক জ্ঞানপিপাসু তরুণ প্রাণ নিয়ে বাস এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে। বাস চলতে শুরু করতেই জমে উঠল গল্প আড্ডা। এর মাঝে বন্ধু পার্থ অবতীর্ণ হলো কন্ট্রাক্টরের ভূমিকায়। সবার কাছে গিয়ে পুরো পেশাদার কন্ট্রাক্ট্ররের মতো ভাড়া চাইতে শুরু করল। ভাড়া না দেওয়া পর্যন্ত চলছে মধুর তর্ক। সবার থেকে দশ/বিশ টাকা করে আদায় করেই ছাড়ল সে। এভাবেই হাসি-আনন্দে চলছিল যাত্রা। হঠাৎ করে এক সময় গাড়ি থেমে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি আমরা গন্তব্যে চলে এসেছি। বাস থেকে নামলাম বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রির প্রধান ফটকে। সেখানে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন ম্যাম ও তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে জুনাইদা জাহিম। ভ্রমণের সব থেকে ছোট সদস্য সে। সেইসঙ্গে যোগ হলো শহরে থাকা বন্ধুরা। ম্যাম এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। নির্দেশনামতো আমরা দুই সারিতে সুশৃঙ্খলভাবে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে মহাব্যবস্থাপক শেখ শামসুজ্জামান সাহেব আরেক দফায় নির্দেশনা দিলেন কিভাবে ঘুরব আমরা। পাশের মেশিনের শব্দে তার সব কথা শুনতে না পেলেও তার কথায় বুঝতে পারলাম ভেতরে ছবি তোলা যাবে না। আমরা লম্বা এক সারিতে মূল ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করলাম। ভেতরের ঢুকতেই আমাদের সামনে এলো বৈদু্যতিক তার উৎপাদনের বৃহদাকার মেশিনগুলো। প্রতিষ্ঠানের এইচ আর বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সাহেব এবং তার সঙ্গে আরও দুজন কর্মকর্তা আমাদের পথ নির্দেশ করছেন। ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন একেকটি মেশিন। আমরা সারিবদ্ধভাবে হেঁটে হেঁটে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম শ্রমিকদের কাজ ও এসব যন্ত্রের কলাকৌশল। একদম সুতোর মতো থেকে শুরু করে এমন মোটা কিছু তার দেখতে পেলাম যেগুলো এর আগে কখনো দেখা হয়নি। কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে আমাদের বর্ণনা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কিছু যন্ত্রের কার্যক্রম। কথা হলো বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে। আমরা সারিবদ্ধভাবে লাইন ধরে এক ভবন থেকে অন্য ভবন ঘুরছিলাম। আমার ডানপিটে স্বভাবের বন্ধুরা যে এতটা সুশৃঙ্খল হতে পারে এই পরিদর্শনে না গেলে হয়তো জানাই হতো না। ৬৫ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ জায়গা পরিদর্শন করলাম আমরা। দীর্ঘ সময় হেঁটে ও উঁচু উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করলেও হাঁপিয়ে যাচ্ছে না কেউ। চলমান মেশিনগুলো যেন শক্তি যুগাচ্ছিল আমাদের। একপর্যায়ে একপাশে নিরিবিলি খোলা জায়গায় কয়েক মিনিটের জন্য বিরতি দেওয়া হলো। এ সময়ে সুযোগ পাওয়া গেল ছবি তোলার। সেলফি আর গ্রম্নপ ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। বিরতি শেষে আমাদের সবাইকে একত্রিত করলেন কামরুজ্জামান সাহেব। আমাদের সামনে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান, অন্যতম বৃহৎ বৈদু্যতিক তার তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাফল্য ও দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা তুলে ধরলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ, শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের সুযোগ-সুবিধাও তুলে ধরলেন তার কথায়। এরপর প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের ব্যাপারে আমাদের জিজ্ঞাসু মনের নানা প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। পরিদর্শন শেষে বেরিয়ে আসার সময় প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক আমাদের শৃঙ্খলার প্রশংসা করে ধন্যবাদ জানালেন ও ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে আমাদের কিছু স্মরণিকা উপহার দিলেন। সেইসঙ্গে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। আমরা পরিদর্শন শেষ করে কুষ্টিয়া শহরে থাকা বন্ধুদের বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ফিরতে শুরু করল ক্যাম্পাসের দিকে। আবারও শুরু হলো গল্প। সবার মুখে শোনা গেল বিআরবি কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার প্রশংসা। গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে। সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে পার্থ কয়েক মিনিটের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরল এক প্যাকেট লজেন্স নিয়ে। যাওয়ার পথে ভাড়া বাবদ তোলা সেই টাকা দিয়ে কেনা লজেন্স। মুখে লজেন্স আর একরাশ ভালোলাগা ও আর সারাদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সবাই ফিরলাম নিজ নিজ কক্ষে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে