শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আলোকিত শিশু স্কুল

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোর মিছিল

নতুনধারা
  ০৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
আলোকিত শিশু স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা

মোহাম্মদ অংকন

সম্প্রতি আমি রাজধানীর হাজারীবাগের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এটি কোনো সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। 'আলোকিত শিশু ফাউন্ডেশন'-এর ক্ষুদ্র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত 'আলোকিত শিশু স্কুল'। শাব্দিক অর্থে তাদের উদ্যোগ ক্ষুদ্র মনে হলেও এর তাৎপর্যতা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এখানে শহরের ধনীর সন্তানরা লেখাপড়া করে না। বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হয়, যাদের বাবা-মা পড়াশোনার বিষয়ে একদমই সচেতন না কিংবা আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে অক্ষম। এসব অভিভাবকের দিনাতিপাত বড়ই কঠিন গোছের। কেউ রিকশা চালায়, কেউ চামড়া মিলে কাজ করে, কেউ সবজি বিক্রেতা যাদের দ্বারা সন্তানদের খাদ্যচাহিদা মেটানো কষ্টকর, সেখানে শিক্ষার প্রসঙ্গ যেন নিরর্থক। তাহলে তাদের সন্তানরা কি অন্ধকার জগতে থাকবে? দেশে যখন শিক্ষার হার বাড়ছে, তখন এসব শিশু পিছিয়ে রবে কেন? এমন প্রশ্ন থেকেই একদল স্বপ্নবান যুবকরা গড়ে তোলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল যার নাম রাখা হয় 'আলোকিত শিশু স্কুল'। 'আলোকিত শিশু ফাউন্ডেশন' তৈরির মাধ্যমে চলছে স্কুলটির কার্যক্রম।

হাজারীবাগের ঝাউচরে অবস্থিত 'আলোকিত শিশু স্কুল' পরিদর্শনের দিন আমার সঙ্গে ছিলেন পাবলিক রিলেশান অফিসার আশরাফুল আলম আশিক। তার মাধ্যমে জানা গেল 'আলোকিত শিশু ফাউন্ডেশন' তৈরির নানা চড়াই-উতরাইয়ের গল্প। কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মাধ্যমে এমন উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত ও দালিত শিশুদের আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা। ক্ষুধার্তদের খাদ্য কিনে দেয়া। বেশকিছু সময় এমনটি চলতে থাকে। তারপর তাদের একতাবদ্ধতা এক সময় আরও তীব্রতর হয়। পরিকল্পনায় উঠে আসে, এসব শিশুকে পড়াশোনা শেখাতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

২০১৫ সালে রাজধানীর রবীন্দ্রসরবরে 'আলোকিত শিশু স্কুল'-এর কার্যক্রম সর্বপ্রথম চালু হয়। এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা)'র কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী মিথুন দাস কাব্য ও তার সহপাঠীরা। সে সময় তার সঙ্গে কাজের প্রতি আঙ্গ্রহ জানায় পাঁচ থেকে সাতজন। (বর্তমানে তার সঙ্গে রয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৭০০-এর অধিক স্বেচ্ছাসেবী।) কিছু পথশিশুকে স্বপ্নবাজ তরুণরা খোলা আকাশের নিচে পড়ানো শুরু করে। তারপর এ থেকে ভালো লাগার জন্ম হয়। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে ওঠে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা। ২০১৬ সালে তাদের নজরে আসে মুন্সিগঞ্জ জেলার বেদে পলস্নী। সেখানে প্রায় ৫০ জন বেদের সন্তানকে নিয়ে নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। গড়ে তোলা হয় 'আলোকিত শিশু স্কুল'। তাদের এই কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে আসে দেশের বৃহৎ আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান 'আইডিএলসির ফাইন্যান্স লিমিটেড'। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় একটি স্কুল ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। যেটি উদ্বোধন করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। দুজন শিক্ষক দ্বারা স্কুলটিতে চলছে নিয়মিত পাঠদান। জানা গেছে, বেদের সন্তানরা পড়াশোনার সুবিধা পাওয়ায় তারা সেখানে স্থায়ীভাবে জীবনযাপন করছে। এ শ্রেণির মানুষ প্রচলিত সমাজে চলতে না পারায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। 'আলোকিত শিশু স্কুল' তাদের জন্য নিবেদিত হওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে সচেতনতা ও শিক্ষার হার।

ওদের হাতের লেখাগুলো চমৎকার। ওদের মাঝে আমার সম্পাদিত একটি ম্যাগাজিন তুলে দিই। ওরা যেন আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। এখানে প্রায় ৩০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়মিত পড়ছে। যাদের সবার স্বপ্ন শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ হওয়া।

'আলোকিত শিশু ফাউন্ডেশন'-এর তিনটি স্কুলে সব মিলিয়ে ১৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রতিটি স্কুলেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া আছে। সংস্থাটি মূলত নিজেদের টাকায় চলছে। প্রতিমাসে প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। মাসিক কিছু অর্থের বিনিময়ে শিশুদের অভিভাবক হওয়া। মূলত এভাবেই সবার সাহায্যে চলছে আলোকিত শিশু স্কুলগুলো!

'আলোকিত শিশু স্কুল' প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃৃতিক ও নৈতিক শিক্ষার ওপরও জোর দিয়ে আসছে। নাটোর, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জে মূলত আলোকিত শিশু কমিউনিটিকে কেন্দ্র করে কাজ করে যাচ্ছে। মূল লক্ষ্য, সমাজের অবহেলিত, সুযোগ বঞ্চিত শিশুরা যেন গুণগত শিক্ষা পায় তা নিশ্চিত করা। বেদে, সুইপার বা ছিন্নমূল বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষ থাকে সাধারণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। পায় না কোনো সুযোগ সুবিধা। এবং তারা অতি দরিদ্র! 'আলোকিত শিশু স্কুল'-এর তরুণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, তাদের এই কার্যক্রমকে চালিয়ে নিতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে পৃষ্ঠপোষক দরকার। বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও, সামাজিক সংস্থা থেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করলে সুবিধাবঞ্চিত হাজার হাজার শিশু 'আলোকিত শিশু স্কুল'-এর মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দেখতে পারবে। অধ্যয়রনত তরুণদের উদ্যোগ সফল হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<60914 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1