ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আর সেটা যদি হয় রমজানের ঈদ তাহলে যোগ হয় আরও বাড়তি উত্তেজনা। শহরে বড়, ছোট সব মার্কেটে হিরিক পড়ে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের। বিত্তবান মুসলিম থেকে শুরু করে, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত সব পেশার মানুষ যখন ঈদের আনন্দকে তার পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের পোশাক কেনাকাটায় ব্যস্ত। তখনও সমাজের একশ্রেণির মানুষ আছে যাদের মনে কোনো ধরনের আনন্দ জাগে না। ঈদের আনন্দও তাদের মনে তেমন কোনো অনুভূতি জাগ্রত করতে পারে না।
যাদের অনেকে থাকে শহরের আশপাশের কোনো বস্তিতে কোনো রকম মাথাগুঁজার মতো ছোট একটি কামরাতে ৫-৬ জনের পুরো পরিবার নিয়ে। আবার কারো সেই সামর্থ্যও নেই, থাকে ট্রেন স্টেশনের ছাউনির নিছে। আজ এই স্টেশনে তো কাল ওই স্টেশনে। এমনি চলে তাদের জীবন সংগ্রাম। আবার তাদের মধ্যে এমন কিছু শিশু আছে জীবনের কোনো ঈদে যাদের মনে আনন্দের ছোয়া লাগাতে পারিনি আজও।
এমনই একজন, সোহেল রানা (বিজয়)। তার বয়স ১২ বছর। থাকে ষোলশহর রেলওয়ে বস্তিতে। বাবা নেই, মা সায়েলা আক্তার একজন গার্মেন্টেস কর্মী। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে বিজয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেছে, বাবার নাম আজও জানে না সে। ভাইবোন বলতে তার কেউ নেই। তার পরনে ছিল পুরাতন পোশাক। পড়াশোনা করার সুযোগই হয়নি বিজয়ের। ঈদ এলে তার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে, খুব গম্ভীর মুখে বিজয় বলে, ভালোই। ঈদে নতুন পোশাক কেনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সে বলে, না এখনো হয়নি তার আর হবে কিনা সেটাও নিশ্চিত না। তবে বিজয় জানায় কোনো কোনো ঈদে তার আম্মা কিনে দেয়, আবার কোনো ঈদে বড়লোক মানুষ থেকে পায়। আর কোনো ঈদে নতুন জামা পেলে কেমন লাগে জানতে চাইলে, সে বলে, আসলে সবসময় পুরতান পরি। ঈদ উপলক্ষে যদি নতুন জামা পাই তাতে অনেক আনন্দ লাগে। নতুন জামা পরে, আমার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাই, আনন্দ লাগে খুব। আর নতুন জামা না কিনতে পারলে তখন আর ঘুরতে ইচ্ছে হয় না। মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
যেখানে তার মতো অন্য আট-দশজন ছেলেমেয়ে বাবার হাত ধরে নতুন জামা পরে খুব আনন্দের সঙ্গে ঈদের নামাজে যায় সেখানে বিজয় জানেই না তার বাবা কে! আর সে জানেও না তার বাবা কখনো ফিরে আসবে কিনা, সে কখনো তার বাবার হাত ধরে এমন করে হাঁটতে পারবে কিনা এবং সমাজে তার বাবার পরিচয়ে বড় হতে পারবে কিনা কোনদিন। তার এতগুলো বাস্তব প্রশ্নের কাছে ঈদের বিশাল আনন্দও যেন ম্স্নান।
এমন আরেকজনের সঙ্গে দেখা মিলল যাদের বড় পরিবার। আর্থিক অনটনে বহু কষ্ট চলে তাদের ৭ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জীবন। সে বিষয়ে কথা হয়, এই পরিবারেরই একজনের সদস্য আঁখি আক্তারের সঙ্গে। আঁখিরা থাকেন ষোলশহরের পাশে তালতলাবস্তিতে। তার বয়স এখন ৯ বছর। বঙ্গবাসন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন আঁখি। বাবা ইউসুফ আলী ফেরি করে আমড়া বিক্রি করে। মা আয়েশা আক্তার গৃহিণী। তাদের পরিবারে দুই ভাই, তিন বোন। ঈদ এলে তাদের অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে সে বলে সবার কাছে ঈদ আনন্দের, তেমনি আমার কাছেও। তবে ঈদে নতুন জামা কাপড় কেনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, মুখে একটা কষ্টের হাসি দিয়ে আখি বলে, না এখনো কেনা হয়নি। আর কারো কাছ থেকে জামা কাপড়ও পায়নি। প্রতি ঈদে নতুন জামা কাপড় কেনা হয় কিনা জানতে চাইলে সে বলে, প্রতি ঈদে নতুন জামা কাপড় কেনা হয় না। কারণ তার বাবার সে সামর্থ নেই। কেউ দিলেই তারা নতুন জামাকাপড় পায়। আর না হয় পুরাতনগুলো দিয়েই কাটে তাদের ঈদ। সব মিলিয়ে তাদের ঈদ আনন্দটা কখনো হয়, আবার কখনো অধরায় থেকে যায়।
ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে দোকাদারি করেন মিলন মিয়া, এক নামে মিলন ভাই বলে আশপাশের সবার কাছে পরিচিত মুখ তিনি। তার বয়স এখন প্রায় ৪০ বছর। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বসুরহাটে। এই স্টেশনে প্রায় ১৫ বছর দোকাদারি করেন তিনি। এই মানুষগুলোর হাসি কান্না সুখ-দুঃখ খুব কাছ থেকে দেখেন মিলন মিয়া। প্রায় সময় অনেক পথশিশু বিনা টাকায় নাস্তাও করে যায় এই দোকানেই। এই যেন মিলন মিয়ার (মিলন ভাই) উদার মনের পরিচয়। এই বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ছোট কালে মা মারা যায়, তারপর বাবা আরেকটা বিয়ে করে। তখন থেকে নানা রকম কাজ করে বহু কষ্টে জীবন সংগ্রাম করে আজ এই পর্যন্ত এসেছি। তাই এই ধরনের পথশিশু যাদের অনেকের বাবা নেই, আবার অনেকের মা-বাবা কেউই নেই, তাদের দুঃখটা একটু হলেও বুঝি। সে জন্য সবসময় তাদের সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করি বিভিন্নভাবে। তিনি বলেন, ঈদ এলে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন তাদের মাঝে ঈদ বস্ত্র বিতরণ করতে দেখি। তবে তারপরও তাদের মধ্যে অনেকে বাকি রয়ে যায় বলে জানান মিলন মিয়া (মিলন ভাই)।