বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সেন্ট মার্টিনে অনন্য শিক্ষা সফর

মাহবুব এ রহমান ও রাকিব হাসান মুন্না
  ২৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
শিক্ষা সফরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রায় প্রত্যেক বিভাগই আয়োজন করে শিক্ষা সফরের। ঠিক তেমনি পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা সবুজাভ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকেও আয়োজিত হয় বার্ষিক শিক্ষা সফরের। স্থান সেন্ট মার্টিন সমুদ্রসৈকত। যাতে অংশ নেন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। তবে এ শিক্ষা সফর গুানুগতিক কোনো শিক্ষা সফর ছিল না। শিক্ষা সফরে ছিল নান্দনিক আর অনন্য সব আয়োজন। 'সমুদ্রকে রাখিব পস্নাস্টিক মুক্ত' এই নীতিকে বুকে ধারণ করে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় 'সৈকত পরিষ্কার কর্মসূচি' উদযাপন করেন। যার নেতৃত্বে ছিলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন মুন্না, সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক ও সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। এ সময় শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ডাস্টবিনে বিভিন্ন প্রকার পস্নাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন।

অসংখ্য পস্নাস্টিক বোতল, পলিথিন, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট পস্নাস্টিক স্ট্র, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট ইত্যাদি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপকে পরিণত করেছে ময়লার স্তূপে। এইভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের থেকে পস্নাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে।

অপচনশীল পস্নাস্টিক বর্জ্য সামুদ্রিক জীবকূলের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী পস্নাস্টিক দূষণের ফলে মারা যায়। পলিথিন, পস্নাস্টিকের ফলে সমুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন পস্নাস্টিক সমুদ্রে পতিত হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন টন পস্নাস্টিক বর্জ্য আছে ? এই পস্নাস্টিক পদার্থের পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে পস্নাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি দৃশ্যমান হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি পস্নাস্টিক ভেসে থাকে?

পস্নাস্টিক দূষণ প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে এটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে বেশকিছু সামুদ্রিক প্রজাতি, যেমন সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলিতে বিজ্ঞানিরা প্রচুর পরিমাণে পস্নাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন এসব পস্নাস্টিক বর্জ্য তাদের পরিপাকতন্ত্রকে নষ্ট করে দেয়। সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃতু্য ঘটছে পস্নাস্টিক দূষণের কারণে? সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ, সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবনধারণ কওে জেলিফিসের আকার ও আকৃতি পস্নাস্টিক ব্যাগের মতো হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে পস্নাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে এতে তাদের খাদ্য নালিকা বন্ধ হয়ে যায়, প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায়।? কচ্ছপের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি; সামুদ্রিক তিমির পাকস্থলিতে প্রচুর পরিমাণে পস্নাস্টিক পাওয়া গিয়েছে।

পস্নাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র সামুদ্রিক মাছের ওপর নয়, সামুদ্রিক পাখির ওপরও রয়েছে। বেশিরভাগ সামুদ্রিক পাখির পেটে প্রচুর পরিমাণে পস্নাস্টিক পাওয়া যায়। সমুদ্রে ভাসমান পস্নাস্টিক ও মাছের মধ্যে তুলনা না করতে পারায় পাখিরা বিভিন্ন পস্নাস্টিক দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।? ২০০৪ সালের এক গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা জানান, 'সামুদ্রিক গিলে'র পেটে ৩০ খন্ডের সমপরিমাণ পস্নাস্টিক পাওয়া যায়- যা বর্তমানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। পস্নাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়।? এই বিষাক্ত রাসায়নিক দেহের বিভিন্ন টিসু্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পাখিরা যখন পস্নাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে তখন তাদেও পেটেও বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়;? এর জন্য তাদেও দেহের টিসু্য ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়; ধীরে ধীরে পাখির মৃতু্য হয়। এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে, উত্তর ক্যারোলাইনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লাইসন অ্যালবাট্রস বাস করে যাদের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে পস্নাস্টিক পদার্থ পাওয়া যায় এবং এর ফলে তাদের মৃতু্য ঘটে।

পস্নাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। খাদ্যজালের মাধ্যমে এসব পস্নাস্টিক মানুষের দেহে প্রবেশ করে জটিল সব রোগ ব্যাধি সৃষ্টি করে। সাধারণত পস্নাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসব রঞ্জক কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

পরিবেশকে এসব দূষণ থেকে বাঁচাতে এবং জনসাধারণের সাথে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের এমন অভিনব আয়োজন।

আয়োজন নিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দিবস দেব বলেন, সমগ্র পৃথিবীর ও এর মানবজাতির নিকটতম ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন। তার ওপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে পস্নাস্টিক দূষণ। নতুন এই ইসু্যটি এ গ্রহে বসবাসরত জনমানুষের চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই এক ঝাঁক তরুণ সমুদ্রবিজ্ঞানীদের নিয়ে সৈকতের পস্নাস্টিক সংগ্রহের মাধ্যমে বিচ ক্লিন আপ কর্মসূচি সম্পন্ন করেছি আমরা। সমুদ্রশিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক সমুদ্র পাড়ের জনগণ - এই আমাদের প্রত্যাশা।

বিভাগের একই বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সাফওয়া বিনতে সাইফ সুপ্তি বলেন, পস্নাস্টিক দূষণ যদি এইভাবে বাড়তে থাকে তবে বিলুপ্ত হবে প্রাণীকুল। তাই পর্যটকরা যাতে পস্নাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে পস্নাস্টিক দূষণ না করে সে জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এই আত্মপ্রয়াস।

সব পর্যটক সমুদ্রকে পস্নাস্টিক মুক্ত রাখবে এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন গড়তে সহায়তা করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42678 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1