বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জীববৈচিত্র্যের লীলাভ‚মি

নাফিউর রহমান ইমন
  ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দযর্। দিগন্তজোড়া কাশফুলের মাঠ, সাদা শুভ্র ফুলের মাঠ, যা কল্পনার জগতকে জাগ্রত করে, এখানে আসলে ছবি তুলতে ইচ্ছে করবে, কাশফুলের নরম ছেঁায়া পেতে ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে করবে হারিয়ে যেতে। এখানে ছোট ছোট টিলা আছে এগুলো আকারে অনেক বড় না হলেও খঁুজে নেয়া যায় পাহাড়ি ফ্লেবার, আরোহন করা যায় নিচ থেকে একেবারে চূড়ায়। মেডিকেল সেন্টারের ঠিক সামনেই আছে ব্রিজ। ব্রিজের পাশে পদ্ম ফোটা লেক, হরেক রকম গাছ-গাছালি, নানা রকম প্রাণী, লালমাটি, উঁচু নিচু রাস্তার কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র রাজধানী বলা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। জাবির লেকগুলোতে ফুটে থাকা লাল লাল শাপলা কিংবা আগাছার ধবধবে সাদা ফুলগুলো যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে আনন্দ যোগায়। হয়তো মাঝে মাঝে আনমনে বলে ওঠেÑ

‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ, ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’

রবীন্দ্রনাথ নিসগের্র যে সৌন্দযর্ নান্দনিকভাবে এঁকে গিয়েছিলেন তা অতুলনীয়। এখানে উচ্ছ¡াস আছে, প্রেম আছে, আধ্যাত্মবাদ আছে, অজানাকে পাওয়ার আকুতি আছে, আছে প্যান্থেয়িজম। কিন্তু প্রকৃতির এই সৌন্দযের্র ভেতরেই যে উইলিয়াম বে কের ‘সিক রোজ’ এর মতো কদযর্ রূপ আছে তা প্রকৃতির শূন্যতা না দেখলে বোঝা যায় না।

প্রকৃতির এই শূন্যতা যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট। দূষণের ফলে প্রকৃতি হারায় তার রূপ, গন্ধ, নান্দনিকতা ও নিমর্লতা। প্রকৃতির এই বিপযের্য়র রয়েছে নানা কারণ। প্রাকৃতিক কারণও যে নেহাত কম নয়, তা বিভিন্ন তথ্য দেখলেই বোঝা যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই পৃথিবী মোট ১৩ বার ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, ফের জীববৈচিত্র্যে ভরে গিয়েছে। এতবার পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ হলো জলবায়ু পরিবতর্ন। এর পেছনে রয়েছে প্রকৃতির অবদান। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাদন থেকে শুরু করে ভ‚গভের্র পেটের সংঘাত অনেক কারণেই পৃথিবীর ভারসাম্য? নষ্ট হয়েছে।

কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ বা মহাদেশীয় সরণ পৃথিবীর স্থলভাগ যখন একটু একটু করে ছেড়ে যেতে শুরু করল তখনই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হলো মহাদেশের। লাখ লাখ বছর আগে এই প্রক্রিয়ায় মহাদেশের জন্ম হয়েছে। মাটির এই সরে যাওয়া বা ছেড়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর স্থলভাগের জলাশয়গুলোর অবস্থানের পরিবতর্ন হয়েছে এবং পরিবতর্ন হয়েছে সমুদ্রের জলস্রোত ও বায়ুপ্রবাহের। এই পরিবতর্নগুলো জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। আজও এই মহাদেশীয় সরণ অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে প্রকৃতির নানা পরিবতর্ন আমরা লক্ষ্য করি।

তবে মানবসৃষ্ট কারণ প্রকৃতি পরিবতের্নর প্রধান নিয়ামক। মানুষ নিবির্চারে গাছ কাটে, আগাছা পরিষ্কারের নামে বনজঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয়, প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান নষ্ট করে। ফলে তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট। বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়ের আবাসস্থল হয় শূন্য পরিত্যক্ত এক ধ্বংসস্ত‚প।

পরিবেশের এই ধ্বংসের খেলায় পিছিয়ে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নানান অজুহাতে কাটা হচ্ছে গাছপালা, বনজঙ্গল, ভরাট করা হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয়। অপ্রয়োজনে আগুন দিয়ে বুনো পাখি ও কীটপতঙ্গের বিচরণস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাথীর্রা। এদিকে অতিথি পাখির বিচরণস্থল লেকগুলোও দিন দিন ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

পৃথিবীর জীবমÐলের অন্যতম গুরুত্বপূণর্ অংশ অরণ্য। আমাদের দেশের অথৈর্নতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে পযার্প্ত বৃক্ষ থাকা খুবই প্রয়োজন। বৃক্ষহীনতার কারণে পৃথিবীর নতুন নতুন অঞ্চল মরুময় হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের ওপর নিভর্রশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানবজীবন সমস্যায় পড়তে পারে আগামী শতকের মাঝামাঝিতে। তিন দশমিক পঁাচ বিলিয়ন কিউবিক মিটার কাঠ ব্যবহার করে প্রতিবছর আট হাজার বগের্হক্টর বনভ‚মি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। বনভ‚মি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ এবং পূবর্-পশ্চিমের বহু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভ‚মিতে বনায়ন ও বৃক্ষায়ন করা প্রয়োজন।

বনায়ন করা এ কারণে প্রয়োজন যে, মানুষ ও বৃক্ষের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে এক গভীর সম্পকর্, পারস্পরিক নিভর্রশীলতা। বিশেষ করে মানুষ ও উদ্ভিদের পরস্পরের দেহাপোযোগী সামগ্রীর জন্য একে অন্যের ওপর নিভর্রশীল। মানুষ কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে (শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়) এবং অক্সিজেন গ্রহণ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কাবর্ন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে। পৃথিবীতে বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে এক সময় মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। এমনকি এটা মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। পরিবেশ ভারসাম্য হারালে আগামী পৃথিবী হুমকির সম্মুখীন হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। তারা বলছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ আশঙ্কায়ই উদ্ভিদ নিধনকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে তুলে ধরেন এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রকৃতিকে ভালোবাসা মনের গভীর থেকে আসে। এটা চেষ্টা করে হয় না। এই প্রকৃতি যদি হারিয়ে যায়, এই গাছপালা যদি না থাকে, তাহলে বৈচিত্র্য থাকবে না। বৈচিত্র্য এ জন্য প্রয়োজন যে, মানুষের জনসংখ্যা এত বেড়ে চলেছে, তাদের খাদ্য জোগান, তাদের ওষুধ, চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বহু কাজে আমাদের এ বৈচিত্র্য প্রয়োজন। বৈচিত্র্য যদি হারিয়ে যায়, জিনগুলো যদি হারিয়ে যায়, তাহলে মানুষ একদিন বিপন্ন হয়ে পড়বে।

দশর্ন বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আনোয়রুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘পরিবেশ ও প্রকৃতি ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব অথর্হীন। উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনের ভ‚মিকা না থাকলেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর প্রকৃতি সংরক্ষণে নানারকম আয়োজন করা হয় এসব সংগঠনের মাধ্যমে। তারই অংশ হিসেবে প্রজাপতি মেলা, পাখি মেলার আয়োজন করা হয় প্রতি বছর । সচেতন নাগরিকরা যদি তাদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তবে সবুজ ক্যাম্পাস একদিন জীববৈচিত্র্য শূন্য মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে। বৈচিত্র্য হারিয়ে জলাশয় হবে বালুকাময় আর অরণ্যে ঘেরা লাল ইটের হলগুলো হবে গাছপালা শূন্য। যেখানে পাখিরা আর গান গাইবে না, সকালের কোমল বাতাসে কচিপাতা আর দুলবে না, প্রজাপতিরা আর ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াবে না মধ্য দুপুরে কিংবা পড়ন্ত বিকেলের লাল আলোয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<25482 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1