এক ঋতু যায় আর এক ঋতু আসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ সাগরে লাগে টেউ। বৈচিত্র্যের সমন্বিত এই রূপ-কান্তি ক্যাম্পাসের প্রকৃতি ও শিক্ষাথীের্দর মাঝে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করে। হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়তাগ্রস্ত শীতের নিমর্ম বাধর্ক্য। শুষ্ক, কাঠিন্য ও রিক্ততার প্রতিমূতির্রূপে শীতের আবিভার্ব ঘটে। যতই দিন গড়ায় ক্যাম্পাসের শীতের তীব্রতা ততই বাড়ছে।
কাকডাকা ভোরে ক্যাম্পাসের শীতের সকালের ঘুম ভাঙে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় সবর্ত্র এক অনিবর্চনীয় আলস্যে ও মদিরতা নিয়ে ভিন্নরকম রূপধারণ করে। হলের কক্ষের কুয়াশাজড়িত জানালার পাশে গাছে গাছে পাখির কণ্ঠে ভেসে উঠে মধুর আবাহন গীতি। গাছের সারিতে পাখিদের সুরলহরী ছড়িয়ে পড়তেছে দিগদিগন্তে। চারিদিকে কুয়াশায় আছন্ন লেপ থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না, তবু আধো ঘুম ঘুম অবস্থায় উঠে দঁাত ব্রাশ সেরে তাড়াতাড়ি পোশাক পরিধান করে কেউ হলের ডাইনিং আবার কেউ ক্যান্টিনের দিকে ছুটে চলে। এই শীতের মৌসুমে ডাইনিংয়ের খাবারের তালিকায় ফুলকপি, বঁাধাকপি, ওলকপি, মূলা, গাজর, শালগম, শিম, টমেটো, পেঁয়াজ পাতা, মোটরশুঁটি, লালশাক, পালংশাকসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি যুক্ত হয়েছে। তাই অন্যান্য সময়ের তুলনাই হলের খাবারের মান এখন অনেকটায় ভালো। কুয়াশার আবরণের আড়ালে শীতের প্রকৃতি বৈরাগ্য ধারণ করলেও রং-বেরংয়ের ফুলের শোভায় ক্যাম্পাস তার সবার্ঙ্গ নতুন রূপধারণ করেছে।
এখানেও শিশির পড়ে, কিন্তু তাতে সবুজ ঘাসের করুণ গভীর ঘ্রাণ মিশে থাকে না; যাইহোক চটপট নাস্তা সেরে নেয়া। ততক্ষণে বাইরের পৃথিবীর ঘুম ভেঙেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে দিকে কমের্র মুখরতায় শীতের সকাল কমর্ব্যস্ত হয়ে উঠছে। পূবির্দগন্তে আলো ছড়িয়ে সূযের্র রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। এরপর যে যার মতো কেউ ক্লাসে, কেউ লাইব্রেরিতে, কেউ ল্যাবে আবার কেইবা পরীক্ষার হলে।
শীতের সকালের প্রধান আকষর্ণ খেজুরের রস এখানেও উত্তরের শীতল হাওয়া বয়ে যায় কিন্তু তাতে খেজুরের রস কিংবা পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধ হৃদয়কে আন্দোলিত না করলেও এই সাত-সকালেই গাছিরা বানেশ্বরের খেজুর রস নিয়ে হলের সামনে হাজির হয়। বলেন, মামা প্রতি গøাস ১০ টাকা, রস পানসে মিষ্টি তারপরও হলের শিক্ষাথীর্রা ওইটা খেয়েই মনের তৃপ্তি মিটায়।
বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক পরীক্ষাগুলো সাধারণত শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষাথীের্দর এই সময়টিতে কখনো লাইব্রেরিতে, কখনো বা দলবেঁধে হবিবুর মাঠে, লিচু বাগানে, সাবাশ মাঠে ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিকে ঘিরে এর চারপাশে গ্রæপ স্টাডি করতে দেখা যায়। এসব স্পটে প্রেমিক যুগলদের সাইকেল দঁাড় করে রেখে হাতে ফটোকপির হান্ডনোট নিয়ে বাদাম, তেঁতুল বা ঝালমুড়ি চিবাতে চিবাতে দুজনের খুনসুটি প্রেম আর স্টাডি করতে দেখা যায়। হীমশীতল রূপমূতির্র মধ্যেই লাইব্রেরির ভেতরের টেবিলকে প্রচ্ছন্ন করে শিক্ষাথীের্দর পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফলাফলের তপস্যার কঠোর আত্মপীড়ন করতে দেখা যায়।
শীতে মায়ের হাতের বানানো পায়েস, নকশি পিঠা, ভাপাপিঠা, পুলিপিঠার প্রকৃত ঘ্রাণ ক্যাম্পাসে না পাওয়া গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর ও স্টেশন বাজারের ভাপাপিঠা রাজশাহীর লোকাল ভাষায় যাকে ধঁুপি বলে তার মধ্যে খেজুর গুড় ও নারিকল দিয়ে বানানো প্রতি পিছ গরম গরম ধুপি ছোট বাটি পঁাচ টাকা বড় দশ টাকা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এ ছাড়াও এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার কলাই রুটি। গরম গরম প্রতি পিছ বিশ টাকা দরে মাষকলাই ও আতপ চাল দিয়ে তৈরি কলাই রুটির সঙ্গে আগুনে পোড়ানো বেগুনে পেঁয়াজ, রসুন, কঁাচামরিচ ও ধনেপাতা মিশ্রিত ভতার্ দিয়ে খেতে বেশ মজাদার।
প্রথম বষের্র খুব কম শিক্ষাথীর্রা হলে সিট পায় আর যারা পায় না তাদের ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হয়; ফলে তাদের শীতের সকাল হয় কেবল শহরের কাকের ডাক, কলের পানির শব্দ, কেরোসিন-কয়লার গন্ধ ও বাস-ট্রাকের ঝনঝনানি নিয়ে। এক কথায় শহরের ইট-কাঠ-পাথরের কৃত্রিম কাঠিন্যের মধ্যে গ্রাম-বাংলার উদাস করুণ শীতের সকালের ¯িœগ্ধ মধুর রূপটিকে ক্যাম্পাসের বাইরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুথর্ বষের্র শিক্ষাথীর্ শাকিল আহমেদ বলেন, আমরা জানি যে, ঊনো বষার্য় দুনো শীত অথর্্যাৎ বৃষ্টি কম হলে শীত বেশি হবে। এই বছর রাজশাহীতে বৃষ্টি কম হয়েছে বুঝায় যাচ্ছে শীতের প্রকোপটা বেশি হবে। বন্ধুরা রংবেরংয়ের বাহারি ডিজাইনের জ্যাকেট, ফুলহাতা গেঞ্জি, বেøজার, হুডি, সোয়েটার, জাম্পার, হাফ সোয়েটার পরে পড়াশুনার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আড্ডায় মেতে উঠি শীতের সকালে চারিদিকে কুয়াশা, প্রভাতের শিশিরভেজা ঘাস, সবুজ ঘাসে শিশির বিন্দু দিনের আলোয় চিকচিক করে উঠা দৃশ্য দেখতে বেশ সুমধুর লাগে। সব মিলিয়ে শীতকালটাকে আমরা খুব উপভোগ করি।
বিকেল বেলা শেখ হাসিনা হলের পুকুর পাড়ে বাবলার ডালে বসে নীলকণ্ঠ পাখি রিক্তপত্র রোদ পোহাচ্ছে। সূযাের্স্ত সাবাশ মাঠে একদল শিক্ষাথীর্ হাতে গিটারের সুরে গানে-গল্প-অড্ডায় মেতে উঠেছে তাদের মাথার ওপর দিয়ে এক জোড়া নাম না জানা পাখি ডানায় বাতাস ফুটিয়ে কুয়াশায় ভেতর দিয়ে কোন এক অজানার পানে ছুটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনের ঋতু বৈচিত্র্যের এমন মিষ্টি অপরূপ দৃশ্যস্পট শিক্ষাথীের্দর হৃদয়ে আজীবন থাকবে চির অ¤øান।