শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেলিম রেজার 'পেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার'

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার দুলস্না ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষিকর্মকর্তা সেলিম রেজা। দেশের কৃষকদের সেবা দেওয়ার জন্য যিনি একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গড়ে তুলছেন ব্যতিক্রম এ সংগ্রহশালা। শুধু সংগ্রহে সীমাবদ্ধ থাকেনি সেলিম, দিচ্ছেন সেবাও। মানুষ চাকরি করে। কিন্তু সেলিম রেজা শুধু চাকরি-ই করেন না, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। শুধু অফিস করেন না, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেন
ওহি আলম
  ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
সেলিম রেজার পেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রয়েছে প্রায় ১০০ জাতেরও বেশি পোকামাকড় -যাযাদি

'আমার গাছে পোকা ধরছে।' 'কী পোকা?' 'এইডা তো কইবার পারুম না।'

'আচ্ছা অসুবিধা নেই। দেখেন তো এই পোকাটা কি না?'

'আরে এইডাই তো!' 'ঠিক আছে, এই ওষুধটা কিনে গাছে দিয়েন। ভালো হয়ে যাবে।'

সম্প্রতি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুলস্না ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও একজন কৃষকের কথোপকথন এটি। রোগ না জানলে যেমন ওষুধ দেওয়া যায় না, তেমনি পোকা-মাকড় সম্পর্কে না জানলে এর প্রতিকারও সম্ভব নয়। শখের বসে আমরা অনেকেই অনেক রকমের জিনিসপত্র সংগ্রহের খবর শুনি। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন পোকা-মাকড় কিংবা আগাছা সংগ্রহ করছে কেউ। জি হঁ্যা, আজ এমনি একজনের কথা বলব, যার সংগ্রহশালাতে রয়েছে প্রায় ১০০ জাতেরও বেশি পোকা। এগুলো যে সে পোকা নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এগুলোর অনেক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার মধ্যে যেমন রয়েছে উপকারী পোকা, ঠিক তেমনি আছে ক্ষতিকর পোকাও। কিন্তু কৃষকতো আর পোকা নিয়ে কৃষি অফিস আসে না। আর পোকার নামও কৃষক জানে না। তাই কৃষককে সঠিক সেবা দিতে ক্ষতিকর ও উপকারী দুই ধরনেরই শতাধিক জাতের পোকা-মাকড় নিয়ে এক সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা।

ধানের মাজরা পোকা, লেডি বার্ড বিটল, গান্ধী পোকা, ক্যারাবিডল বিটল, ড্যামসেল ফ্রাই, বাদামি গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ সুর লেদা পোকা, পামরি পোকা, ড্রাগন ফাই, মাকড়সা, কয়েক ধরনের প্রজাপতিসহ পোকায় আক্রান্ত বিভিন্ন গাছের পাতা, রোগে আক্রান্ত গাছ ও ফলের প্রায় ২০০ ধরনের নমুনা রয়েছে সেখানে। এ ছাড়াও এখানে সংগ্রহে আছে আবাদি জমির নানাবিধ আগাছা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ৭০ জাতের ধান। তার সংগ্রহে রয়েছে বিনা ও বারি উদ্ভাবিত ধানও। আছে এ যাবত কালের কৃষি সংক্রান্ত সব বই, লিফলেট, কৃষিবিষয়ক সব অনুষ্ঠানের ভিসিআর ও সিডি ভিডিও। বাদ যায়নি বিভিন্ন ধরনের সারও।

আর এ ব্যতিক্রমধর্মী সংগ্রাহক হলেন- ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার দুলস্না ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা। দেশের কৃষকদের সেবা দেওয়ার জন্য যিনি একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই গড়ে তুলছেন ব্যতিক্রম এ সংগ্রহশালা। শুধু সংগ্রহে সীমাবদ্ধ থাকেনি সেলিম, দিচ্ছেন সেবাও। সঠিক, সময়োপযোগী এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষকদের সেবা দিয়ে এলাকায় ইতোমধ্যেই 'কৃষক বন্ধু' উপাধি পেয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

এলাকার কৃষকরা পরামর্শের জন্য এলে তিনি সংগ্রহশালার পোকাগুলো দেখিয়ে ফসল বা গাছের পোকা কিংবা কি ক্ষতি হচ্ছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং সে অনুযায়ী পরামর্শ দেন কৃষকদের। আর এই পুরো বিষয়টিকে তিনি ভালোবেসে নাম দিয়েছেন 'পেস্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার'। দেশের অনেক বড় বড় কোম্পানি বা কর্মকর্তারা যা করতে পারেনি, তিনি তা করে দেখিয়েছেন সহজেই। দীর্ঘ ২৯ বৎসরের চাকরি জীবনে অর্জন করেছেন অনেক নামিদামি স্বীকৃতি ও পুরস্কার। দুবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার, দুবার প্রযুক্তি সম্প্র্রসারণে বিভাগীয় জাতীয় পুরস্কার, বিভাগীয় ইনোভেশন পুরস্কারসহ মোট ২১টি পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

এমন ব্যতিক্রমধর্মী সংগ্রহের শুরুটা জানতে চাইলে সেলিম রেজা জানান, চাকরি জীবনের শুরুতেই কৃষকের কিছু সমস্যা তাকে ভাবিয়ে তোলে। দেখা যেত তারা যে রোগ বা পোকা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটির সঠিক বর্ণনা দিতে বা দেখাতে পারতো না। সেখান থেকেই তার মনে হতে শুরু হয়, এমন যদি কোনো ব্যবস্থা থাকতো যে কৃষকরা দেখেই তার সমস্যা চিনে ফেলতে পারবে। আর তারপর ১৯৯৮ সালে থেকে তিনি প্রথম একটি আলমারি নিয়ে শুরু করেন তার সংগ্রহের সূচনা। তখন তিনি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় কর্মরত ছিলেন। প্রথম প্রথম তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পরবর্তী সময়ে সেগুলোর নানাবিধ সমাধানও তিনি নিজেই করেছেন। বর্তমানে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুলস্না ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি রুমে রয়েছে তার এ বিশাল সংগ্রহশালাটি।

\হসেলিম রেজা ১৯৮৯ সালে কৃষিতে ডিপেস্নামা নেওয়ার পর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে কৃষি বিভাগে যোগ দেন। প্রথম পোস্টিং ছিল সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। সেখানে গাছের কলম পদ্ধতি শিখিয়ে এলাকায় আলোড়ন তোলেন। এরপর ধাপে ধাপে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে এখন তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় দুলস্না ইউনিয়নে আছেন প্রায় সাত বছর ধরে। সেলিম রেজা কৃষি, কৃষকের সমস্যা, গাছ ও ফসলের রোগ বালাই, জৈব পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন চাকরি জীবনের শুরু থেকেই। কাজ করতে করতে এক সময় তার মনে হলো কৃষককে পরামর্শ দিতে গেলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সেলিম রেজা এ ব্যাপারে বলেন, কৃষকতো আর জানে না পোকার নাম কি। কোন পোকা উপকারী কিংবা ক্ষতিকর তাও জানে না। কৃষক কীটনাশকের দোকান থেকে অনুমানে ওষুধ কিনে নিয়ে ব্যাপকভাবে এসব ব্যবহার করে। এতে কৃষক, ফসল, জমি, পরিবেশ সব কিছুরই ক্ষতি হয়। এ চিন্তা থেকেই আমি পোকা-মাকড় নিয়ে এবং রোগাক্রান্ত গাছ নিয়ে একটি সংগ্রহশালার কথা ভাবি। এরপর অনেক পরিশ্রম করে, এসব পোকা সংগ্রহ করতে থাকি।

সেলিম রেজা বলেন, ২০০৩ সালে তিনি প্রথম মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি মেলায় শস্য ক্লিনিক ও পোকার চিড়িয়াখানা নামে একটি স্টল প্রদর্শন করেন। ওই সময় সেটি ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে। এরপর বিভিন্ন মেলাসহ এই সেন্টারটি প্রায় ১৫ হাজার দশনার্থী পরিদর্শন করেছেন। তিন শতাধিক ব্যক্তি এ সেন্টারটি সম্পর্কে মন্তব্য লিখেছেন। গত চার মাসে দুলস্না ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে স্থাপিত তার সেন্টারে প্রায় ১৫০ জন কৃষক এসেছেন। এসেছেন ২৭ জন বিভিন্ন এলাকার কৃষি কর্মকর্তা। এ ছাড়া সময়ে সময়ে এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষি কর্মকর্তাদের শিক্ষানবিশ দলও আসেন।

\হসেলিম রেজা বলেন, কোনো কৃষক এলে প্রথমে তিনি কৃষককে ৭২টি প্রশ্ন করেন। এ প্রশ্নগুলো লিখিতভাবে তার কাছে আছে। প্রশ্নগুলোর মধ্যে গতানুগতিক কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন কৃষকের নাম কি, বাড়ি কই। এরপর জানতে চাওয়া হয় কোন ফসল, কি জাত, কতদিন ধরে সমস্যা। সমস্যা কোথায় পাতায়, কান্ডে, ফুলে না ফলে। গাছের/ফসলের কতভাগ আক্রান্ত ইত্যাদি। সব শেষে তিনি কৃষকদের পরামর্শ কিংবা ব্যবস্থাপত্র দেন।

মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, 'সেলিম রেজা খুবই ভালো একজন কৃষি কর্মকর্তা। কৃষকদের উনি ভালোভাবে গুছিয়ে বুঝাতে পারেন। ভালো কাজের জন্য এলাকার মানুষ ভালোবাসে। বিষমুক্ত সবজি চাষে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।'

দুলস্না ইউনিয়নের পূর্ব দুলস্না গ্রামের রিয়াজুল করিম ফরহাদ বলেন, 'মানুষ চাকরি করে। কিন্তু সেলিম রেজা শুধু চাকরি-ই করেন না। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। শুধু অফিস করেন না, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেন।' গয়েশপুর গ্রামের শরীফুল ইসলাম বলেন, 'আমি যে কোনো কাজ করতে গেলে তার পরামর্শ নেই। যখনই তাকে ডাক দেই, তখনই তিনি চলে আসেন।'

চাকরি করতে করতে সেলিম রেজা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএজিএড (ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচারাল এডুকেশন) কোর্স করেছেন। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বর্তমানে তিনি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে এমএস কোর্স করছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেলিম রেজা বলেন, 'আমার সংগ্রহশালাটি এখন একটি ছোট রুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এটিকে বড় পরিসরে ময়মনসিংহ শহরে স্থানান্তরিত করতে চাই এবং এটাকে দেশের সব কৃষকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চাই। তা ছাড়াও আরো বড় কিছু পরিকল্পনাও আছে এটিকে ঘিরে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80893 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1