বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারকেল ছোবড়ায় কম্পোস্ট সার তৈরির প্রযুক্তি

কৃষিবিদ তারেক আজীজ
  ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
নারকেল ছোবড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে কম্পোস্ট সার - যাযাদি

নারকেল ছোবড়া থেকে সার উৎপাদন কৃষিতে একটি নতুন প্রযুক্তি। নারকেলের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ উপজাত দ্রব্য বাইরেরটা, অর্থাৎ খোল। এটা থেকেই নারকেলের ছোবড়া তৈরি হয়। এই ছোবড়া তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রচুর বর্জ্য বেরোয়- যা মূলত ছোবড়ার ধুলো বা ছোবড়ার ছাল। ফুল, ফল ও সবজি চাষ বৃদ্ধির উপযোগী হওয়ায় ছোবড়া সারের বেশি গুরুত্ব। যদিও নাইট্রোজেন ও কার্বনের অনুপাত খুব বেশি হওয়ায় এবং পচনের হার কম হওয়ায় একে এখনও কৃষি উপযোগী ভালো কার্বনের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় না। নাইট্রোজেন ও কার্বনের অনুপাত, লিগনিন ও সেলুলোজের পরিমাণ কমাতে ছোবড়া বর্জ্যকে কমপোস্ট সারে পরিণত করা হয়। কমপোস্ট হলে এটা অনেক হালকা হয়ে যায় এবং একে চারাগাছের পুষ্টির জন্য ব্যবহার করা যায়। ছোবড়া বর্জ্য শিল্প ক্ষেত্র থেকে তন্তু ছাড়া সংগ্রহ করা হয়। তন্তু থাকলে চালুনি দিয়ে তা ঝেড়ে নেওয়া হয়। না হলে সার তৈরির পর কম্পোস্টের জায়গায় এগুলোকে আলাদা করতে হয়। এগুলো সারে পরিণত হয় না বরং এগুলো সার তৈরির প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে থাকে। তাই তন্তুহীন ছোবড়ার বর্জ্যই সংগ্রহ করা উচিত।

স্থান নির্বাচন

সার তৈরির জন্য আলাদা স্থান নির্বাচন করা জরুরি। উঁচু এলাকা হলে ভালো হয়। নারকেল গাছের মাঝে, গাছের ছায়া সারের প্রস্তুতির পক্ষে ভালো। ঢাকা এলাকায় সারের মধ্যে আর্দ্রতা সংরক্ষিত থাকে। সার তৈরির জমি যেন উঁচু-নিচু না হয়। যদি মাটির মেঝে পাওয়া যায়, তা হলে তাকে ভালো করে পরিষ্কার করে, গোবর দিয়ে লেপে নেওয়া যেতে পারে। সারের উপাদানের ওপর ছাদ থাকলে ভালো, কারণ তাতে উপাদানগুলোক বৃষ্টি এবং সূর্যের তেজ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। ছোবড়া বর্জ্য থেকে সার তৈরি একটি সবাত প্রক্রিয়া। এর জন্য গর্ত বা সিমেন্টের পাত্রের প্রয়োজন নেই। একে মাটির ওপরেই রাখা যায়। ছোবড়া বর্জ্যকে ৪ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট চওড়া আকারে রাখতে হয়। শুরুতে একে ৩ ইঞ্চি পুরু করে রেখে ভালো করে ভেজানো হয়। ভেজানোর পর নাইট্রোজেনজাতীয় দ্রব্য মেশানো হয়। এই দ্রব্য ইউরিয়া হতে পারে বা পোল্ট্রির জঞ্জালও হতে পারে। যদি ইউরিয়া দেওয়া হয় তা হলে এক টন ছোবড়ায় ৫ কিলো ইউরিয়া দিতে হবে। এই ৫ টনকে সমান ৫ ভাগে ভাগ করতে হয়। পোল্ট্রির লিটার হলে প্রতি টন বর্জ্যে ২০০ কিলো মেশাতে হবে। পোল্ট্রি লিটার আনুপাতিক ভাবে ভাগ করে ছোবড়া বর্জ্যের ওপর রাখা হয়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ১ টন ছোবড়া বর্জ্যকে ১০ ভাগ করা হলে, প্রতি স্তরে ১০০ কেজি পোল্ট্রির বর্জ্য দিতে হবে। এর ওপর আরও এক অংশ ছোবড়া বর্জ্য রাখা হয় এবং তাকে উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে মিশ্রিত করা হয়। নূ্যনতম ৪ ফুট উঁচু চুড়া করে পুরো উপাদান রাখা উচিত। কিন্তু ৫ ফুটের বেশি উঁচু হলে প্রস্তুতিতে যন্ত্রের প্রয়োজন হবে। সার তৈরির প্রক্রিয়ায় যে তাপ উৎপন্ন হয়, উচ্চতা বাড়লে সেই তাপমাত্রা সংরক্ষিত হয়। উচ্চতা কম হলে, যতই তাপ উৎপন্ন হোক, তা সহজেই বেরিয়ে যায়। ভালো সার তৈরির জন্য উপযুক্ত জায়গা বাছাই করা অত্যন্ত জরুরি।

উপাদান ঝাড়াই

প্রতি ১০ দিনে একবার সারের ঝাড়াই করা দরকার, এতে স্তূপের মধ্যে জমে থাকা বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে এবং তাজা হাওয়া ঢুকতে পারে। সার তৈরির প্রক্রিয়া একটি সবাত প্রক্রিয়া। যে সব প্রাণ সার তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাদের বিপাকীয় প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। বাতাস চলাচলের আরও একটি পদ্ধতি হলো সার তৈরির উপাদানগুলোর মধ্যে উলম্ব ও আনুভূমিকভাবে ছিদ্রযুক্ত পিভিসি বা লোহার পাইপ ঢুকিয়ে রাখা।

আর্দ্রতা রক্ষার উপায়

বর্জ্য পদার্থকে সুষমভাবে সারে পরিণত করতে একটা সন্তোষজনক মাত্রায় আর্দ্রতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। ৬০ শতাংশ আর্দ্রতা রক্ষা করতেই হবে। সারের উপাদানগুলোর ৬০ শতাংশ ভেজা থাকতেই হবে। কিন্তু বাড়তি জল বর্জ্য পদার্থ থেকে বের করে দিলে চলবে না, উপাদানগুলোকে হাতে করে নিংড়ে নিতে হবে। যদি এতে একটুও জল না বেরিয়ে আসে, তা হলে বুঝতে হবে, উপযুক্ত আর্দ্রতা বজায় রয়েছে।

সারে পরিণত হওয়ার সময়কাল

সার তৈরি হওয়ার সময়কাল যে স্থলে সার তৈরি হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে। যদি ওপরে বলা সমস্ত শর্ত পূরণ করা হয়, তা হলে ৬০ দিনে কম্পোস্টের কিছু ভৌত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। প্রথমত, বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ কমে যায়। বর্জ্য কম্পোস্টে পরিণত হয়ে গেলে কম্পোস্টের উচ্চতা ৩০ শতাংশ কমে যায়। দ্বিতীয় লক্ষণ হলো, বর্জ্য পদার্থের রং কালো হয়ে যায় এবং বর্জ্য উপাদানগুলোর আকার ছোট হয়ে আসে। তৃতীয় লক্ষণ হলো, সার তৈরির উপাদান থেকে মাটির গন্ধ বেরোয়। সার কতটা তৈরি হয়েছে, তার রাসায়নিক লক্ষণগুলো পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করলেই জানা যায়। রাসায়নিক লক্ষণগুলো হলো, কার্বনও নাইট্রোজেনের অনুপাত কমে আসা (২০:১), অক্সিজেন নির্গমন কমে যাওয়া, জীবাণুর পরিমাণ কমে যাওয়া, পুষ্টিবিধায়ক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

সার সংরক্ষণ

চালুনিতে ঝেড়ে যে সার পাওয়া যায়, তা ব্যবহারের উপযুক্ত। যদি সার তখনই না ব্যবহার করা হয়, তা হলে আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য সেটাকে খোলা, ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে, যাতে সারে উপস্থিত উপকারী জীবাণুগুলো না মরে যায়। আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য মাসে একবার সারের ওপর জল ছড়াতে হবে।

ছোবড়া সারের সুবিধা

ছোবড়ার সার মাটির গুণ বাড়ায়। বেলে মাটি আঁটোসাঁটো হয় এবং কাদা মাটি আরও উর্বর হয়। এই সার মাটির সুষমভাব বাড়ায়। এই সার মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায় (শুকনো মাটির ওজনের ৫ গুণেরও বেশি)। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা বাড়ে। ছোবড়া সার প্রয়োগের ফলে নিচের স্তরের মাটির (১৫-৩০ সেমি)ঘনত্ব কমে। ছোবড়া সারে ফসলের সব পুষ্টিবিধায়ক পদার্থ থাকে এবং এই সার অজৈব সারের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এই সারের প্রয়োগের ফলে মাটিতে উপস্থিত মাইক্রোফ্লোরার পরিমাণ বাড়ে। ছোবড়া সার জীবাণুর কার্যকারিতা বাড়ায়, ফলে মাটিতে অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে।

ছোবড়া সারের ব্যবহার ও প্রয়োগমাত্রা

প্রতি হেক্টর জমিতে ৫ টন ছোবড়া সার ব্যবহার করা দরকার। বীজ রোপণের আগে মাটির তলায় ছোবড়া সার ব্যবহার করতে হবে। পলিথিনের ব্যাগে বা টবে গাছ লাগাতে হলে মাটির সঙ্গে ২০ শতাংশ ছোবড়া সার মিশিয়ে পলিথিন ব্যাগ বা টবে ভরা উচিত। নারকেল, আম, কলা বা অন্যান্য ফল গাছে সার দিতে হলে, অন্তত ৫ কিলো ছোবড়া সার দিতে হবে।

ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা

ছোবড়া সার কিনে বড় ক্ষেতে ব্যবহার করা খুব একটা লাভজনক নয়। ছোবড়া সার নিজের খামারে তৈরিই সুবিধাজনক। সার কেনার আগে বুঝে নেওয়া দরকার, পুরো উপাদানটি কমপোস্টে পরিণত হয়েছে কি না। সারের সঙ্গে গুণাগুণ নির্দেশিকা অবশ্যই থাকতে হবে। যদি অপরিণত সার ব্যবহার করা হয়, তা হলে মাটিতে প্রবেশের পরেও এটির পচন চলতে থাকবে, ফলে মাটির পুষ্টিবিধায়ক পদার্থ কমে যাবে। এতে ফসলের ক্ষতি হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<78878 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1