বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজের বিকল্প নতুন মসলা ফসল চিভ

সুখবর দিলেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। তারা এমন একটি মসলা ফসল শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন যেটি পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আবার দামও কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য মতে, আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন, চাহিদা প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন। এখনো প্রায় ৪.৬৫ লাখ মেট্রিক টন ঘাটতি রয়েছে। নতুন ফসল চিভ পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব এবং এটি সারা বছর চাষ করা যায়...
ড. মো. নুর আলম চৌধুরী
  ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

পেঁয়াজের ঝাঁজে নাকাল ভোক্তাদের জন্য সুখবর দিলেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। তারা এমন একটি মসলা ফসল শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন যেটি পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আবার দামও কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য মতে, আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন, চাহিদা প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন। এখনো প্রায় ৪.৬৫ লাখ মেট্রিক টন ঘাটতি রয়েছে। নতুন ফসল চিভ পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব এবং এটি সারা বছর চাষ করা যায়। কাজেই চিভের প্রসার ও পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে পেঁয়াজের ঘাটতি অনেকটা মেটানো সম্ভব।

মসলা ফসল চিভের বৈজ্ঞানিক নাম- অষষরঁস :ঁনবৎড়ংঁস। এটি একটি অ্যামারাইলিডেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর পাতা লিনিয়ার আকৃতির, ফ্ল্যাট, পাতার কিনারা মসৃণ, বাল্ব লম্বা আকৃতির। এর ফুলের রঙ সাদা-পার্পল বর্ণের। পুষ্পমঞ্জরি অম্বেল প্রকৃতির। এর উৎপত্তিস্থল সাইবেরিয়ান-মঙ্গোলিয়ান-নর্থ চাইনা অঞ্চল। আমাদের দেশে এটি পেঁয়াজ ও রসুনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মসলা ফসল হিসেবে স্যুপ ও সালাত তৈরিসহ বিভিন্ন চাইনিজ ডিসে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা, কন্দ ও অপরিপক্ব ফুল সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি হজমে সাহায্য করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণাগুণ বিদ্যমান। আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করার মাধ্যমে এটি কলার পানামা রোগ নিয়ন্ত্রণ সাহায্য করে। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'সি', ভিটামিন 'বি'-১, ভিটামিন 'বি'-২, নায়াসিন, ক্যারোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। তুলনামূলকভাবে সিলেট অঞ্চলে এর চাষাবাদ বেশি হয়ে থাকে। তা ছাড়া পেঁয়াজ উৎপাদনকারী এলাকা যেমন- পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী (দুর্গাপুর ও তাহেরপুর), মাগুরা, বগুড়া, লালমনিরহাট ইত্যাদি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।

চিভের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা চিভের বেশ কয়েকটি লাইনের ওপর গবেষণা চালিয়ে বারি চিভ-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যা সারাদেশে সারা বছর চাষ করা সম্ভব। জাতটি ২০১৭ সালে অবমুক্ত হয়। জাতটির বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন প্রযুক্তি নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

এ জাতের গাছের উচ্চতা ৩০-৪০ সেমি.। পাতার দৈর্ঘ্য ২৩-৩০ সেমি.। বাল্ব লম্বাকৃতির, বাল্বের দৈর্ঘ্য ১.০-১.৪৫ সেমি.। চারা লাগানো থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত ৬৫-৭০ দিন সময় লাগে। এটি পোকামাকড় ও রোগ সহনশীল। ফলন হেক্টর প্রতি ১০-১২ টন (গাছ ও পাতাসহ)

মাটি ও জলবায়ু : সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোআঁশ মাটি চিভ চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ ৬.৩-৬.৮ হলে চিভের বৃদ্ধি ভালো হয়। চিভের চাষের জন্য বছরে ২৫০০-৩০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। ১৩-২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা চিভ চাষের জন্য উপযোগী।

জমি তৈরি : জমিতে ৬-৭টি গভীরভাবে (১৫-২০ সেমি.) চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে কারে ও পরে মই দিয়ে সমতল করতে হবে। জমির আগাছা বেছে ফেলতে হবে। মাটির ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরে ও সমান করে জমি তৈরি করতে হবে। চিভ চাষের জন্য ৩.০ মিটার বাই ১.৫ মিটার আকারেরর বেড তৈরি করতে হবে এবং বেডের উচ্চতা ১৫-২০ সেমি. হতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য দুই বেডের মাঝে ৫০-৬০ সেমি. প্রশস্ত নালা থাকতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : ফলন বেশি পেতে হলে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার প্রয়োগ মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পায় ও ফলন বেশি হয়। মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ওপর সারের মাত্রা নির্ভর করে। চিভের জন্য প্রতি হেক্টরে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় সবটুকু গোবর/কম্পোস্ট, টিএসপি, অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া এবং এমওপি সার সমান ভাগে ভাগ করে যথাক্রমে চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগের আগে জমি আগাছামুক্ত করতে হবে।

রোপণ সময় : বাংলাদেশে সারা বছর চিভ চাষ করা সম্ভব। তবে চিভ লাগানোর উপযোগী সময় এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত।

বীজ হার ও রোপণ দূরত্ব : প্রতি হেক্টরে ২০০০০০-৩০০০০০ চারা/ক্লাম্প ডিভিশন (ঈষঁসঢ় ফরারংরড়হ) লাগে। প্রতিটি চারা ২০-২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে ১৫-২০ সেমি. পরপর লাইন করে লাগাতে হবে।

আন্তঃপরিচর্যা: চিভের চারা রোপণের পর একটি পস্নাবন সেচ দিতে হবে। চারা রোপণ এবং সেচের পর জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মাতে পারে। আগাছা জমির রস ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এ জন্য ২-৩ বার বা ততধিক নিড়ানি দিয়ে জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। জমির জো অবস্থা দেখে ২০-২৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে।

ফসল সংগ্রহ : চারা লাগানোর ৬৫-৭০ দিন পর থেকে ফসল সংগ্রহ করা যায়। গাছের গোড়া থেকে ২-৩ ইঞ্চি ওপরে পাতা কেটে অথবা পুরো গাছ উঠিয়ে ফসল সংগ্রহ করা যায়। ফসল সংগ্রহের পর বাজারজাতকরণের জন্য পাতা/গাছ ভালোভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে এবং গাছের শিকড় কেটে ফেলতে হবে। বছরে ৫-৬ বার ফসল সংগ্রহ করা যায়।

ফলন : পাতা ও গাছসহ প্রতি হেক্টরে ১০-১২ টন ফলন পাওয়া যায়।

রোগবালাই : চিভে রোগের আক্রমণ খুব কম হয়। তবে জমিতে আর্দ্রতা বেশি থাকলে সেক্লরোসিয়া জাতীয় ছত্রাকের আক্রমণ হয়। এ ছাড়া পার্পল লিফ বস্নচ নামক রোগের আক্রমণ হতে পারে।

পার্পল লিফ বস্নচ : অলটারনারিয়া পোরি নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত বীজ, বায়ু ও গাছের পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। এই রোগের আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে গাছের পাতা বা পুষ্পদন্ডে ছোট ছোট পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়। অনুকূলে আবহাওয়ায় পাতা বা পুষ্পদন্ডে এক বা একাধিক দাগ পড়ে এবং তা দ্রম্নত বৃদ্ধি পায়। দাগের মধ্যবর্তী অংশ প্রথমে লালচে ও পরবর্তী সময়ে কালো বর্ণ ধারণ করে এবং দাগের কিনারায় বেগুনি রঙ দেখা যায়। দাগের মধ্যস্থ গাঢ় অংশ ছত্রাকের বীজকণা দিয়ে পূর্ণ থাকে। সাধারণত আক্রান্ত পাতা ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে হলুদ হয়ে মরে যায়।

দমন পদ্ধতি : সুস্থ, নীরোগ বীজ ও চারা ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোভরাল বা ভিটাভেক্স ২০০ নামক ছত্রাকনাশক কেজি প্রতি ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ২ গ্রাম রোভরাল এবং ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর ৩-৪ বার গাছে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার এমিস্টারটপ মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর ৩-৪ বার গাছে স্প্রে করলে রোগের প্রকোপ কমে যায়।

পোকামাকড় ও দমন পদ্ধতি: চিভে পোকামাকড়ের আক্রমণ খুব কম হয়। তবে মাঝে মধ্যে থ্রিপসের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। আক্রান্ত পাতায় ক্ষুদ্রাকৃতির বাদামি দাগ দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে পাতা শুকিয়ে যায়। সাবান মিশ্রিত পানি ৪ গ্রাম/লিটার হারে প্রয়োগ করতে হবে। কেরাটে/এডমেয়ার/গেইন প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করে সহজেই এই পোকা দমন করা যায়।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76764 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1