শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাতের বিকল্প রুটিফল!

আসমা অন্বেষা
  ১২ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ছোটবেলায় একটি মজার গল্প শুনেছিলাম অগ্রজের মুখ থেকে। কোনো এক নাবিক জাহাজডুবির পর ভাসতে ভাসতে এক অজানা দ্বীপে গিয়ে ওঠেন। সেই অজানা দ্বীপের গাছে গাছে ঝুলে ছিল রুটিফল। নাবিক তাই খেয়ে প্রাণে বেঁচে যান সে যাত্রায়। ওই বড়ভাই অনেক বই পড়তেন এবং কল্পকাহিনী বানানোর ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন। আমরা ছোট ভাই-বোনরা ধরেই নিয়েছিলাম ওটা বানানো গল্প। রুটি কি কখনো গাছে ঝুলতে পারে? বড়বেলায় ব্রেডফ্রটের অস্তিত্ব জানতে পারলাম একদিন। বাংলা অনুবাদ করে বুঝলাম ওটাই রুটিফল। এতদিনে ভাইয়ের গল্পের বাস্তবতা অনুধাবন করলাম।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এই ব্রেডফ্রুট বা রুটিফল একটি প্রধান খাবার। এ ফলের বাহির ও ভিতরটা কঁাঠালের মতোই। ¯øাইস করে কেটে রুটির মতো সেঁকে খাওয়া যায় এই ফল। ভাত ও রুটির মতো কাবোর্হাইড্রেট ও সুগার সমৃদ্ধ এই ফল খেয়ে জীবন ধারণ করা সম্ভব। ফলের মাঝখানে কঁাঠালের দÐের মতো একটা রিসেপ্টেকল (ভুতি) রয়েছে যাকে ঘিরে থাকে বীচি। এটি একটি যৌগিক ফল। কঁাঠালের আঠার মতো আঠাও আছে। ভেতরে কঁাঠালের মতোই কোষ আছে। ৫০ ফুটেরও বেশি লম্বা হয় রুটিফল গাছ। গাছের পাতা ডেউয়া গাছের মতো বড় বড়। পাতাগুলো চিরল ও মসৃণ। শাখাগুলো বিস্তৃত, বড় আকারের সবুজ পাতায় ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এরা।

রুটিফল গাছ কঁাঠাল পরিবারের (গড়ৎধপবধব) গাছ। এই ফলের বৈজ্ঞানিক নাম আরটোকারপাস আলটিলিস (অৎঃড়পধৎঢ়ঁং ধষঃরষরং)। এদের আদি বাস দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১৮ শতকের দিকে আনা হয় এই ফল কৃতদাসদের জন্য সস্তা খাবারের উৎস হিসেবে। এখন অনেক দ্বীপের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই খাবার। এই সমস্ত অঞ্চলে রুটিফলকে রোস্ট করে খাওয়া হয়। এটাকে ফ্রিজ করেও রাখা যায়। ওরা একে নারিকেলের তেলে ভেজেও খায় যা খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত করা যায়। এদের ক্রিসপি করে ভাজা টুকরো প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই খাওয়া যায়। ওভেনে বেক করলে অথবা তেলে ফ্রাই করলে, রুটি বেক করার মতো সুন্দর ঘ্রাণে ভরে যায়। সেই কারণেই এই ফলের নামকরণ হয় ব্রেডফ্রুট এবং তার বাংলা অনুবাদ করলে হয় রুটিফল।

শ্রীলঙ্কা থেকে একটি ব্রেডফ্রুট বা রুটিফল গাছ নিয়ে আসেন একজন সামরিক কমর্কতার্। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার দেন তিনি গাছটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বোটানিক্যাল গাডেের্ন পরিপূণর্ভাবে বেড়ে উঠেছে রুটিফল গাছটি। ওশেনিয়া অঞ্চলের রুটিফলের গাছ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে। ফল এসেছে গাছ ভরে। শিকড় থেকে জন্মানো আরও একটি চারা বড় হয়েছে। বিশাল শাখা বিস্তৃত এই গাছ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ। এই বাগান ছাড়াও বাংলাদেশে আরো দু-তিনটি রুটিফল গাছ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাছটি বাংলাদেশের পরিবেশের জন্যও উপযোগী বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও আমাদের দেশে এর ব্যাপক চাষ হতে সময় লাগবে তবুও এর সম্পকের্ জানা থাকা ভালো কারণ তা থেকেই আমাদের আগ্রহ তৈরি হবে এই ফলের প্রসার ঘটানোর। সাধারণত এগুলো রান্না করেই খাওয়া হয়। আধাপাকা রুটিফলের তরকারি অনেকটা আলুর মতো লাগে খেতে। এই ফল শকর্রা সমৃদ্ধ এবং একই সাথে প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপাদানও রয়েছে। তাই ভাত, রুটি, কাসাভা এবং ভুট্টা জাতীয় শকর্রা সমৃদ্ধ ফসলের বিকল্প হিসেবেই এটা ব্যবহার করা যায়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপাঞ্চলে এই রুটিফলই প্রধান খাদ্য। দিনে দিনে এই ফল ছড়িয়ে পরে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণপূবর্ এশিয়া, মাদাগাস্কার, মালদ্বীপ, ফ্লোরিডা এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ৯০টি দেশে।

মজার ব্যাপার হলো, এই ফলগুলো দেখতে ফলের মতো হলেও স্বাদে রুটির মতো যা পুষ্টিতে ভরপুর। এই শক্তিশালী ফল ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে অনেক বছর ধরে প্রধান খাবার হিসেবে বিরাজ করেছে। সেখানেই এগুলো জন্মাতো। একবেলার খাবারে ব্রেডফ্রুটে থাকে প্রচুর অঁাশ জাতীয় খাবার, ১০০ ভাগ ভিটামিন সি থাকে প্রতিদিনের চাহিদা মোতাবেক এবং থাকে প্রায় ডজন খানেক গুরুত্বপূণর্ নিউট্রিয়েন্ট। ব্রেডফ্রট ইন্সটিটিউটের এথনোবটানিস্ট ডায়েন রেগোনি (উরধহধ জধমড়হব) জানান, রুটি ফল যে কোনো স্টেজে খাওয়া যেতে পারে। যখন ছোট থাকে তখন এটা খেতে আরটিচোকের মতো লাগে, যখন এরা ম্যাচিউর করে তখন আলুর মতো আর যখন এটা পেকে যায় তখন ডেসাটর্ হিসেবে খাওয়া যায়। হাওয়াই দ্বীপে এটা আলুর মতোন প্রধান খাদ্য হিসেবে খাওয়া হয়। তাই ওখানে একে গাছ আলু বা ঃৎবব ঢ়ড়ঃধঃড় বলে ডাকা হয়। আলুর চাইতে উন্নত মনে করা হয় এই ফলকে। এতে যেমন আলুর মতো কারবোহাইড্রেট আছে, সেই সাথে আছে উন্নত মানের প্রোটিন এবং প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও নিউট্রিয়েন্ট।

এই কারণেই রেগোনি বহু বছর ব্যয় করেছেন এই ফলের ওপর গবেষণা করে এবং পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অংশের দরিদ্র এলাকায় লাগানোর চেষ্টা করে চলেছেন, যেখানে অনেক ক্ষুধাতর্ মানুষের বাস। তার মতে রুটি ফল গাছ দ্রæত বাড়ে, পরিচযার্র জন্য অনেক কম পরিশ্রমের দরকার হয়, কম সার এবং কম পেস্টিসাইড দরকার হয়। একটি গাছ বছরে ২৫০ টির মতো ফল উৎপাদন করে থাকে, যা একটি পরিবারের আহার জোগানোর জন্য যথেষ্ট মনে করেন তিনি। বড় পরিসরে চাষ করলে রুটি ফল একজন কৃষকের পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে ব্যবসা করতে পারে।

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকষর্ণ করতে পেরেছে এই ফল এবং প্রচুর গবেষণা হয়েছে এর ওপর। এই ফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে গবেষণা হয়েছে ক্যান্সার, হাটের্র অসুখ, ইনফ্লামেশন ইত্যাদি অসুখ নিরাময়ে এই ফলের ভ‚মিকা নিয়ে। এমাইনো এসিডে পরিপূণর্ এই ফল। আমাদের শরীরের বিল্ডিং বøক হলো এমাইনো এসিড। এরাই আমাদের শরীর গঠনে বেসিক কাজ করে, অঙ্গ সংগঠনে এবং অগার্নগুলোকে সচল রাখতে বিরাট ভ‚মিকা রাখে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভারসিটির এক স্টাডিতে জানা যায় রুটিফলে প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিডগুলো পূণর্ মাত্রায় রয়েছে এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ঢ়যবহুষধষধহরহব, ষবঁপরহব, রংড়ষবঁপরহব ধহফ াধষরহব।এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিড্যান্ট আছে। হাটের্র জন্য এই ফল খুবই উপকারী। এতে প্রচুর পরিমাণে অঁাশ রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ এবং হাইপারটেনশনের ঝুঁকি কমায়। রুটিফলে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে, যা হাটর্ ফেল করার ঝুঁকি কমায়। চুলের বৃদ্ধির জন্য ভালো ভ‚মিকা রাখে এই ফল এবং সেই সাথে খুশকিও দূর করে। আরও অনেক গুণাবলি রয়েছে এই ফলের যা প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে প্রকাশ করা দুষ্কর।

বিদেশি ফল এদেশে আমদানি করে এদেশের মাটিতে ব্যাপকভাবে চাষ করার ব্যাপারে অনেক দ্বিমত রয়েছে। এমন সমৃদ্ধ একটি ফল এদেশের মাটিতে চাষ হলে মন্দ কি? অতীতের অনেক ফসল তাদের প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে, জায়গা করে দিয়েছে অন্য ফসলের। মানুষ তাতেই অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। এক সময় রান্না হতো সরিষার তেলে। এই তেল ছাড়া অন্য বিকল্পের কথা ভাবতেই পারত না সেই যুগের মানুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<7551 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1