শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নার্সারি-কন্যা নূরজাহান

নতুনধারা
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

এ কিউ রাসেল

নূরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোনো এক বাদলা দিনে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামে জন্ম তার। চার ভাই তিন বোনের সংসারে তার অবস্থান পাঁচ। জন্মের সময় পরিবারের আর কেউ তেমনভাবে খুশি হতে না পারলেও তার বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন। জন্মের পরপরই বাবা ঘোষণা দিয়েছিলেন তার এ মেয়েটিকে এমএ পাস করাবেন।

নূরজাহান বেগম এমএ পাস ঠিকই করেছেন কিন্তু সেই দৃশ্যটা, সব থেকে ভালোবাসার মানুষটি তা দেখে যেতে পারেননি। তিনি যখন ৭ম শ্রেণিতে পড়েন তখন তার বাবা মমতাজ আলী শেখ মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তাদের সংসার/পরিবার। সপ্তম শ্রেণিতেই হয়তো থেমে যেত তার লেখাপড়া। কিন্তু মা হালিমা বেওয়ার দৃঢ়চেতা মনোভাবের ফলে সব ঠিক হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৬ সালে ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও একই কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে বিএ পাস করেন।

২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে যোগ দেন ব্র্যাকের মাইক্রো ফিন্যান্স প্রোগ্রামে। সেখান থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন ব্র্যাকের আরেকটি প্রোগ্রামে। মূলত এই প্রোগ্রামে কাজ করতে করতেই পাল্টে যেতে থাকে জীবনের গতি। নিবিড়ভাবে শিখতে থাকেন তার ভালোবাসার কাজটি। পরিবারের শত বাধা উপেক্ষা করে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারির এক পিকআপ ভ্যান চায়না-৩ জাতের লিচু কলমের চারা নিয়ে হাজির হন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামের নিজ বাড়িতে। শুরু করেন নতুন জীবন।

বাবার দেয়া ২০ শতক জমি আর নগদ ১ লাখ টাকা দিয়ে গড়ে তুললেন 'তোয়া' নামের এক নার্সারি। বাড়ির সবাই বিরোধিতা করলেও ময়মিনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট ভাই ফরিদ সাহস যুগিয়েছেন নানাভাবে। শুরুতেই সফলতা পাননি নার্সারি কন্যা নূরজাহান বেগম। প্রথম বছর লিচু কলমের চারা ব্যতীত আর সবই ছিল বনজ গাছের চারা। চারা বিক্রির সময় হলে তিনি দেখলেন বনজ গাছের চারায় যত টাকা ব্যয় করেছিলেন সবই লোকসান। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, মানুষ যে ধরনের গাছের চারা চায় তিনি সেই ধরনের চারা তার নার্সারিতে ঠাঁই দেননি। মানুষের চাহিদা ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি গাছের চারা আর তিনি করেছেন নিম থেকে শুরু করে দেশীয় জাতের বনজ চারা।

এক দিকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান আর অন্যদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশি কোনো জাতের চারা না করার অঙ্গীকার। বড়ই টালমাটাল অবস্থা। কি করবেন জানা নেই। আবার হেরে যেতেও তার বড় লজ্জা। নীতির কাছে আপসহীন নারীর আপস কোনোভাবেই হতে পারে না। তিনিও আপস করেননি, লেগে গেলেন নতুন করে। এবার আর তাড়াহুড়া করে নয়, জেনে বুঝে। আবারো ছোট ভাই ফরিদ এগিয়ে এলেন। সেই সময় টিভি-পত্রিকায় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি জনপদ গারো বাজারে বসবাসরত আজিজ কোম্পানির অনেক নামডাক। ছোট ভাই ফরিদ জানালেন, চাষি আজিজের সব সফলতার কথা। বললেন, তুমি যেহেতু ফলের গাছেরই নার্সারি করবে তাই ওনার কাছ থেকে ঘুরে আস। এক বৃষ্টি-বাদলার দিনে অনেক কষ্ট করে পৌঁছে গেলেন চাষি আজিজের বাড়িতে।

পরেরটুকু জানালেন চাষি আজিজ। বললেন, বৃষ্টির দিনে পাহাড়ি রাস্তা কাদায় কোমর পর্যন্ত দেবে যায়। তেমনি ৫ কি. মি. রাস্তা পেরিয়ে নূরজাহান যখন আমার বাড়িতে উপস্থিত হন তখন তাকে দেখে চেনার উপায় নেই- সে মানুষ না মহিষ! তার সব কিছু জানার পর আমার অনুভূতি, ১ হাজার জন পুরুষ মানুষ যা না পারবে এই মেয়ে একাই তাই করে দেখাবে।

জহুরি চিনতে ভুল করেননি চাষি আজিজ। চাষি আজিজের পরামর্শ ও সহযোগিতায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন নূরজাহান বেগম। জেলা পর্যায়ে চারবার সেরা নার্সারির পুরস্কার পেয়েছেন। সার্বক্ষণিক ২ জন কর্মচারী আর ৬ হাজার বিভিন্ন জাতের ফলজ গাছের চারায় ভরপুর তার নার্সারি। ১ লাখ টাকা মূলধনের নার্সারি নিষ্ঠা আর সাধনায় ফুলে ফেপে হয়েছে ১০ গুণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66732 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1