শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভেষজ উদ্ভিদ চাষের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বার্ষিক কী পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক ইউনানী ও ২ শতাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে বহু ভেষজ প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে ২০ হাজার টনেরও বেশি ভেষজ কাঁচামালের চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩০০ থেকে পৌনে ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করা হয়
রায়হান পারভেজ রনি
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই যুগ যুগ ধরে বিভিন্নরূপে ও বিভিন্ন নামে মানুষের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় ভেষজ ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলিত ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার কারণে বর্তমানে ভেষজ ওষুধের উপযোগিতা শেষ হয়েছে বলে অনেকে মনে করলেও সে ধারণা দিনে দিনে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে ভেষজ ওষুধ প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। ভেষজ ওষুধ অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ভেষজ ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত সামগ্রিকভাবে ঔষধ বিজ্ঞান তথা আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধও সমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। কারণ এসব ওষুধের আদি ও মূল ভিত্তিও ভেষজ উদ্ভিদ এবং এখনো অসংখ্য আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ সরাসরি উদ্ভিজ্জ দ্রব্য এবং সেগুলোর নিষ্কাশিত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অগণিত মানুষ ভেষজ ওষুধের বদৌলতে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। পৃথিবীর সার্বিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ ভেষজ ওষুধের ওপর নির্ভর করে তাদের রোগব্যাধির চিকিৎসা করে থাকেন। অর্থাৎ ভেষজ ওষুধ না থাকলে এই বিরাট জনগোষ্ঠী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতো।

ভেষজ উদ্ভিদ চাষের যৌক্তিকতা

ভেষজ ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদের উৎস থেকে সংগ্রহ বা আহরণ করা হয়। সাধারণত বনে-জঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকা ঔষধি উদ্ভিদ থেকেই ভেষজ ওষুধের কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে জমিতে চাষকৃত উৎস থেকে ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহ বাঞ্ছনীয়, না হলে এক সময় প্রকৃতি ভেষজ উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়বে। তা ছাড়া চাষকৃত ভেষজ উদ্ভিদের গুণগতমান অনেক উন্নত হয়ে থাকে। চাষের আওতায় ঔষধি উদ্ভিদের উৎপাদন ও আহরণ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে তা সংগ্রহ করার সুযোগ থাকে। বন্য উৎস থেকে সংগৃহীত কাঁচামালের ক্ষেত্রে এ ধরনের নিশ্চয়তা থাকে না। এ ক্ষেত্রে ভুল উদ্ভিদ ও দ্রব্য আহরণের যেমন আশঙ্কা থাকে তেমনি অসময়ে আহরিত নিম্নমানের কাঁচামাল সরবরাহেরও প্রচুর সুযোগ থাকে। অসময়ে, অপ্রাপ্ত বয়সে ও ভ্রান্ত পদ্ধতিতে সংগৃহীত ঔষধি উদ্ভিদ দ্বারা ভেষজ ওষুধ তৈরি হলে তা কখনো গুণগত মানসম্পন্ন হয় না।

অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদ চাষে কৃত্রিম কীটনাশক ও সার প্রয়োজন হয় না। অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদ থেকে সারা বছর ধরে অথবা খুব অল্প সময়ে ফল বা প্রয়োজনীয় অংশ সংগ্রহ করা যায়। এ কারণে তুলনামূলকভাবে ভেষজ উদ্ভিদ চাষে বিনিয়োগ অনেক কম কিন্তু লাভ বেশি। মাশরুমসহ আরো বেশ কিছু ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে- যা চাষে জায়গা খুবই কম লাগে, তাই ভূমিহীন বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভেষজ উদ্ভিদ চাষ উপযোগী। আর্থিক দিক থেকে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ অন্য যে কোনো কৃষির চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। দেশে-বিদেশে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রি বা বাজারজাতকরণে কৃষককে তেমন বেগ পেতে হয় না। এ কারণে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রি বা বাজারজাতকরণে কৃষককে তেমন বেগ পেতে হয় না। এ কারণে ভেষজ উদ্ভিদ চাষে ঝুঁকি কম। ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অপেক্ষাকৃত কম শ্রমসাধ্য। ভেষজ উদ্ভিদে খুব বেশি পরিচর্যা প্রয়োজন হয় না, তাই নারীর অংশগ্রহণে পারিবারিক পর্যায়ে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ সম্ভব। দেশে ব্যাপকভাবে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ সম্ভব হলে ভেষজ চিকিৎসা ও ভেষজ ওষুধ আরো বেশি সহজলভ্য হবে, ফলে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে।

ভেষজ উদ্ভিদ চাষের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে সর্বমোট ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা কত তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা ৫৪৬টি উলেস্নখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। কারণ আমাদের দেশে অধিকাংশ উদ্ভিদ ও লতা-গুল্মেরই ভেষজ গুণ রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য সবজি ও মসলাজাতীয় সবগুলো উদ্ভিদই উচ্চমাত্রার ভেষজ গুণসম্পন্ন।

বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার

বাংলাদেশে বার্ষিক কী পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক ইউনানী ও ২ শতাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে বহু ভেষজ প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে ২০ হাজার টনেরও বেশি ভেষজ কাঁচামালের চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩০০ থেকে পৌনে ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করা হয়। এগুলো সাধারণত ভেষজ ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওষুধ ও ভেষজ প্রসাধনী তৈরির কারখানা অনেক বেড়েছে, আর সঙ্গতকারণে ভেষজের চাহিদাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া শহরে এবং গ্রামে অলিতে-গলিতে বিক্রি হয় অনেক ভেষজ উদ্ভিদ। সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন কবিরাজ, টোটকা চিকিৎসক ও উপজাতি এবং আদিবাসী সমপ্রদায় প্রতিদিন ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ, যার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

বিশ্ব বাজারে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা

সমগ্র বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর ১.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ ওষুধ বিক্রি হয়। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক চিকিৎসায় যেসব অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়। জার্মানিতে এ চাহিদা বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত 'ভেষজ ওষুধ' বইতে ড. আবদুল গনি এ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। পৃথিবীতে উন্নত দেশগুলোতে যেসব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করা হয় তার প্রায় ৩৩ শতাংশ ভেষজ রাসায়নিক থেকে প্রস্তুত করা হয়। রাশিয়ায় প্রস্তুত ও ব্যবহৃত অ্যালোপ্যাথি ওষুধের শতকরা ৪৭ শতাংশেরও বেশি ভেষজ থেকে প্রস্তুত করা হয়। অনুজীব উদ্ভূত ৬০ শতাংশ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুত হয় ভেষজ থেকে। ফ্রান্স-জার্মানিতে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ চিকিৎসক তাদের চিকিৎসাসেবা প্রদান কাজে ভেষজ ওষুধের ওপর নির্ভর করে থাকেন।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাব মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। প্রতি বছর এই চাহিদা ১০.১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমানে এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই ভারত ও চীনের দখলে। ভেষজ উদ্ভিদের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়াও পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আবুধাবি, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যাপক ব্যবহার ও চাহিদা রয়েছে। অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করছে। ভেষজ ওষুধ ব্যবহারকারী সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা। আমাদের দেশ থেকে বর্তমানে বহির্বিশ্বে যে পরিমাণ নিমচারা রপ্তানি হচ্ছে তা মোট চাহিদার ১ শতাংশেরও কম।

ভেষজ উদ্ভিদ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যে কোনো ফসল চাষের চেয়ে বহুগুণ বেশি লাভজনক এবং নিরাপদ। সমগ্র বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে চীন প্রতি বছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত আয় করে ৬ বিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার আয় ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শতভাগ রপ্তানি সম্ভাবনা ছাড়াও ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করে কৃষক তুলনামূলক অধিক লাভ করতে পারেন। অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদের চাষ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ। সার ও কীটনাশকের ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ, এ কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। গুল্মজাতীয় ভেষজ প্রায় বিনা পরিচর্যা ও বিনা খরচে উৎপাদন সম্ভব, অথচ এসব উদ্ভিদের বাজার দর বেশ চড়া।

দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেষজ বাগান

আমাদের দেশে প্রচুর লতা-গুল্মজাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে, যা গ্রামেগঞ্জে, পতিত জমিতে বিনা পরিচর্যায় জন্মায়। আমরা যদি পরিকল্পিতভাবে অতি প্রয়োজনীয় এবং সহজলভ্য ভেষজ উদ্ভিদের পারিবারিক বাগান গড়ে তুলতে পারি, তবে একদিকে যেমন আমরা ছোটোখাট রোগব্যাধিতে বিনা পয়সায় ওষুধ পাব তেমনি এসব ভেষজ পরিবারে বাড়তি অর্থের জোগান দিতে পারে। পারিবারিক পর্যায়ে ভেষজ বাগান গড়ে তুলতে বিশেষ কোনো যত্ন বা ব্যয়ের প্রয়োজন নেই, বাড়ির আনাচে-কানাচে এবং পরিত্যক্ত জমিতে অনায়াসেই এসব উদ্ভিদের চাষ করা যায়। বাড়ির নারী সদস্যরাই এসব বাগান পরিচর্যা করতে পারেন। নাটোরের আফাজ উদ্দিন (পাগলা আফাজ) এ ধরনের একটি সফল উদ্যোগ নিয়ে সরকারি স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তিনি একক প্রচেষ্টায় নাটোরের লক্ষ্ণীপুর, পিজ্জিপাড়া, ইব্রাহিমপুর, সোনাপুর, চানপুর, দক্ষিণপুর, দোয়াতপাড়া, সুলতানপুরসহ বেশ কিছু গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছেন দেশের একমাত্র 'ঔষধি গ্রাম'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<65825 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1