বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সবজি হিসেবে বঁাশের কেঁাড়ল

মৃত্যুঞ্জয় রায়
  ০৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

রাঙামাটির কাপ্তাই লেক দিয়ে একটা মামার্ গ্রাম অংচাজাই কাবাির্রপাড়া থেকে ফেরার পথে দুপুরে খাওয়ার আয়োজন হলো কণর্ফুলীর তীরে চাংপাং রেস্টুরেন্টে। লেকের মধ্যে একটা দ্বীপ-পাহাড়ের চ‚ড়ায় রেস্তোরঁঁাটা। সেগুন বনের মধ্যে বেশ নিরিবিলি-নিজর্ন একটা পরিবেশ। পাহাড় চ‚ড়ায় উঠে মনটা অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে গেল। কিন্তু খাবার টেবিলে যখন খেতে বসলাম, সঙ্গী সুপ্রিয় ত্রিপুরা বলল, দাদা আজ বঁাশ খাওয়াব। মানে কি? কাউকে বঁাশ দেয়া আর বঁাশ খাওয়ানো তো কোনো ভালো কিছু হতে পারে না। বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। টেবিলে ঠিকই বঁাশ চলে এলো। সুপ্রিয় বলল, এই খাবারের নাম বুদিয়া বা বঁাশভতার্। আর একটি খাবার এলো, কচি বঁাশের কেঁাড়ল দিয়ে পুঁইশাক রান্না করা হয়েছে। মিতিঙ্গা বঁাশের কোড়ল আংটির মতো চাক চাক করে কেটে পুঁইশাকের পাতা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। এরপর এলো বঁাশ-মুরগি ক্যাবাং। আধফালি বঁাশের মধ্যে মুরগির টুকরোগুলো রঁাধা। সবই ইথনিক ফুড বা আদিবাসী খাবার। সঙ্গী মিজান বলল, খেয়ে দেখুন, মজা পাবেন। এই প্রথম বঁাশ খাবো, সত্যি সত্যি বঁাশ খাবো। জাহিদ বলল, দিনটা তো ঐতিহাসিক হতে চলেছে রে সুপ্রিয়। তবে সত্যি সত্যি তামাশার মধ্যে কিন্তু ওটা খেয়েই ফেললাম। মন্দ লাগলো না। এরপর থেকেই লেগে পড়লাম খাদ্য হিসেবে বঁাশের কেঁাড়লের খেঁাজ খবরে। সুপ্রিয় জানালো, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি আদিবাসীদেরই প্রিয় একটা খাদ্য হলো বঁাশের কেঁাড়ল। যে কোনো অতিথি আপ্যায়নে এটি একটি বিশেষ খাবার। মে থেকে অক্টোবর পযর্ন্ত এ অঞ্চলে বঁাশের কেঁাড়ল পাওয়া গেলেও বষার্কালটাই আসলে সবচেয়ে ভালো সময়। এ সময় গজানো বঁাশের কেঁাড়লের কোনো তুলনা হয় না।

বঁাশের কেঁাড়ল শুধু পাবর্ত্য চট্টগ্রামেই নয়, সিলেটেও সমান জনপ্রিয়। তবে বিশ্বে বঁাশের কেঁাড়ল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জাপানে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি বছর বঁাশখাদক লোকদের কাছে বঁাশের কেঁাড়লের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫০ হাজার টন। বিশ্ব বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ বঁাশের কেঁাড়লের ক্রেতা জাপান। আর সবচেয়ে বেশি বঁাশের কেঁাড়ল উৎপন্ন হয় চীনে। চীন প্রতি বছর বিশ্বের ৩৭টি দেশে গড়ে ১৩৭ হাজার টন টিনজাত বা প্যাকেটজাত বঁাশের কেঁাড়ল রপ্তানি করে থাকে। কোরিয়া, জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, জামাির্ন, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বঁাশের কেঁাড়লের প্রচুর চাহিদা ও বাজার রয়েছে। এসব দেশ ছাড়া ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও বঁাশের কেঁাড়ল জনপ্রিয় খাদ্য।

আমাদের দেশে সমতল অঞ্চলে বিভিন্ন মৌসুমে প্রচুর সবজি ফলে। তাই এসব এলাকার লোকেরা বঁাশের দিকে কোনো আগ্রহ দেখান না। কিন্তু পাবর্ত্য এলাকায় তেমন কোনো সবজি হয়না, জুমে কিছু সবজি হয়। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তারপরও বষার্কালে সেসব জুমে প্রায় কোনো সবজি থাকে না। তাই ওসব অঞ্চলের মানুষেরা বঁাশের কেঁাড়লকে একটি অন্যতম সবজি হিসেবে রান্না করে খায়। তবে এটা শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই নয়, সমতলের লোকেরাও সবজি হিসেবে রান্না করে খেতে পারেন। কেননা, বঁাশের কেঁাড়ল বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর।

চীনারা বঁাশের কোড়লকে বলেন ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা।’ তাজা বঁাশের কেঁাড়লে ৮৮-৯৩% পানি, ১.৫-৪% প্রোটিন, ০.২৫-০.৯৫% চবির্, ০.৭৮-৫.৮৬% চিনি, ০.৬০-১.৩৪% সেলুলোজ এবং ১.১% খনিজ পদাথর্ আছে। ভিটামিনও আছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে যে বঁাশের কেঁাড়ল দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, উচ্চ রক্তচাপ কমায় ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, হঁাপানি, ডায়াবেটিস, তীব্র জ্বর, মৃগি রোগে মূছার্ যাওয়া ইত্যাদি নিরাময়েও যথেষ্ট অবদান রাখে। তাই যে কোনো সবজির সাথে তুলনা করলে বঁাশের কেঁাড়ল কোনোভাবেই হেলাফেলার নয়।

বঁাশের কেঁাড়ল বস্তুটা আসলে কি? বঁাশের মোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে শিঙের মতো যে কচি কাÐ গজায়, ওটাই বঁাশের কেঁাড়ল বা কোড়ক নামে পরিচিত। ইংরেজিতে বলে ব্যাম্বু শ্যুট। এ থেকেই পরে বঁাশ হয়। কিন্তু যত কেঁাড়ল গজায় তত বঁাশ হয় না। অনেক কেঁাড়ল গজানোর পরও নষ্ট হয়। তাই এসব বাড়তি কেঁাড়ল নষ্ট না করে বঁাশের জন্য কয়েকটা কেঁাড়ল রেখে বাকিগুলো কেটে সবজি হিসেবে খেলে বা বিক্রি করলে তাতে বঁাশ ঝাড়ের কোনো ক্ষতি হয় না। আমাদের দেশে সব বঁাশের কেঁাড়লই সিদ্ধ করে ও রান্না করে খাওয়া যায়। তবে মূলী, ফারুয়া, বরাক, মিতিঙ্গা, প্যঁাচা ও ওরা বঁাশের কেঁাড়ল অত্যন্ত সুস্বাদু।

সাধারণত বৃষ্টি শুরু হলে মোথা থেকে কেঁাড়ল বের হতে থাকে। কেঁাড়ল ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা হলে তা ধারালো চাকু বা দা দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হয়। তবে কেঁাড়ল কাটার সময় খেয়াল রাখা উচিত কাটার কারণে বঁাশ ঝাড়ের মুথা ও অন্য কেঁাড়ল যেন ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। এরূপ কেঁাড়ল সংগ্রহের পর গরম পানিতে তা ৪৫ মিনিট সিদ্ধ করে কেঁাড়লের বাইরের খোসা চাকু দিয়ে ছাড়াতে হয়। এরপর কচি মাংসল অংশ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে পানিতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে এবং তাতেও নরম না হলে আবার পানিতে সিদ্ধ করে সে পানি ফেলে দিয়ে সবজি, মাছ বা মাংসের সাথে মসলা দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। তবে রান্না ছাড়া সালাদ, আচার, স্যুপ ইত্যাদি তৈরি করেও বঁাশের কেঁাড়ল খাওয়া যায়। বঁাশকে বলা হয় গরিবের কাঠ। তাই বলে বঁাশের কেঁাড়লকে গরিবের খাদ্য ভাবার কোনো কারণ নেই। কেননা, রাঙামাটির বনরূপা বাজারেই দেখলাম এক কেজি বঁাশের কেঁাড়ল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। বিদেশে না জানি আরও কত দাম! তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বঁাশের কেঁাড়ল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ আছে। তবে সেজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<6487 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1