শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘোষিত বাজেট ও কৃষির টেকসই উন্নয়ন

কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো ধীরে ধীরে কৃষি থেকে শিল্পের দিকে যেতে হবে। কৃষি থেকে আসবে শিল্পের কাঁচামাল। কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির জোগান দিবে দেশে স্থাপিত শিল্প-কারখানা। এতে কৃষির সঙ্গে শিল্পের গড়ে উঠবে এক সুদৃঢ় সেতুবন্ধন। আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ২০৪১ সালের মধ্যে পরিণত হবে...
কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায়
  ১৬ জুন ২০১৯, ০০:০০

মহান জাতীয় সংসদে গত ১৩ জুন, প্রথমবারের মতো বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকারও বেশি। যার মধ্যে কৃষিতে ভর্তুকির জন্য প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে কৃষিঋণের প্রবাহ ও গ্রামীণ ক্ষুদ্রশিল্পে ঋণের জোগান বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেয়া হবে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী 'আমার গ্রাম, আমার শহর' এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও মনোযোগ দেয়া হবে। সারা পৃথিবীতেই কৃষি অনিরাপদ, অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পোকামাকড়, রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অবাধ বাণিজ্য কৃষিকে করছে আরো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অভাব, কৃষি উপকরণ এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কৃষিকে ফেলেছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। শুধু কৃষি ও কৃষকের জন্য নয়; দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যও এই চ্যালেঞ্জ সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। কারণ এখনো জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪ শতাংশের বেশি। দেশের ৪০ ভাগের বেশি শ্রমশক্তি কৃষিকাজে নিয়োজিত। ৬০ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ বাড়ছে। এ অর্থ দিয়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা, রপ্তানি উন্নয়ন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন সরবরাহসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেয়া হবে। স্বল্প আয়ের জনগণকে সহনীয় মূল্যে পণ্য ও সেবা সরবরাহের জন্য সরকার বাজেটে ভর্তুকির বরাদ্দ রাখে। কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে সরকার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে সার ও ডিজেল বিক্রি করে। আবার সার ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দারিদ্র্যবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ভর্তুকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ব্যয়ের সাড়ে ৮ শতাংশের সামান্য বেশি, যা চলতি বাজেটে রয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের ওপর।

চলতি বছরের মতো বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ থাকে, অনেক সময় ছাড় হয় তার চেয়ে কম। কৃষিমন্ত্রীর কথা গত অর্থবছরের বরাদ্দকৃত বাজেটের বেঁচে যাওয়া ৩ হাজার কোটি টাকা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কাজে ব্যবহার করা হবে। এতে কৃষকের পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেকটা হ্রাস পাবে। সেচ, সার, বীজ, সুদ, ও নগদসহ বিভিন্ন উপায়ে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খাতে ভর্তুকি কমানো ঠিক হবে না। দেশ বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, তার পেছনে ভর্তুকির অবদান রয়েছে। আবার মৎস্য, গবাদিপশুসহ অন্যান্য খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্যও ভর্তুকির প্রয়োজন। সরকারি পাটকলের লোকসান বা মূলধন বাবদ ভর্তুকি হিসেবে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে এবারের বাজেটে। এতে পাটকলগুলো কৃষকের কাছ থেকে সময়মতো পাট কিনতে ও মূল্য পরিশোধে সক্ষম হবে।

রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। বাড়বে বিদ্যুতের দাম। কমবে রপ্তানি আয়। ব্যাহত হবে অর্থনীতির গতি। আমাদের মতো দেশে ভর্তুকি এক ধরনের বিনিয়োগ, যা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনুঘটকের কাজ করে।

সম্প্রতি (গত ২৯ মে) সিরডাপ মিলনায়তনে 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অংশীদারিত্ব ও বাজেট ভাবনা' শীর্ষক সেমিনারে দরিদ্র কৃষকের স্বল্পমেয়াদি সুদবিহীন ঋণের জন্য বাজেটে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানানো হয়। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের মতে, কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্যবাজার মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে। ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের বিমা সুবিধার আওতায় আনার জন্য বাজেটে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া হাওর অঞ্চলে উন্নয়নের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দসহ ভূমি সংস্কারের জন্যও বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার দাবি জানানো হয় সেমিনার থেকে।

বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগামীতে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন মেধাবী প্রজন্ম। আর এই মেধাবী প্রজন্মের জন্য দরকার পুষ্টিকর, নিরাপদ খাবার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমাদের দেশে ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার এবং পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা দমনের জন্য এলোপাতাড়িভাবে ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক বালাইনাশক। ফলে মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা শক্তি এবং মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য থেকে। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে রাসায়নিক সারের পাশাপাশি ব্যবহার করতে হবে ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট ও আবর্জনা থেকে উৎপাদিত জৈব সার। এ জন্য দেশের প্রতিটি নগরে আবর্জনা থেকে জৈব সার উৎপাদনের পস্নান্ট স্থাপনসহ রাসায়নিক সারের মতো জৈব সারে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য ফসলের ক্ষেতে যে বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়, তার অবশিষ্টাংশ খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে মানুষ হৃদরোগ, প্যারালাইসিস, ডায়বেটিস, কিডনি বিকল, ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্রের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হচ্ছে। তাই নিরাপদ খাদ্যের জন্য আমাদের ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ এবং নিমপস্নাস ও নিমবিসিডিনের মতো জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। এতে একদিকে ফসল উৎপাদনের খরচ কমবে। অন্য দিকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে। এ জন্য ফেরোমোন ফাঁদ, দেশে তৈরি বা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সব জৈব বালাইনাশকের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ও কর যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে হ্রাস করতে হবে। ফলে জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়বে। দেশের মানুষ পাবে নিরাপদ খাবার।

বর্তমানে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ লোক নগরে বসবাস করেন। যতদিন যাবে নগরবাসীর সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাবে। নগরবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রতিটি নগরে পরিকল্পিত নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আসন্ন বাজেটে এ ব্যাপারেও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। ধানসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের কমপক্ষে ২০ শতাংশ সরাসরি কৃষকে কাছ থেকে সরকারিভাবে ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ধান সংরক্ষণ উপযোগী শস্যগুদাম নির্মাণ করতে হবে। শাকসবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্যও গড়ে তুলতে হবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক হিমাগার। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য উত্তম কৃষি চর্চা ও সংযোগ চাষির মাধ্যমে গুণগত মানের রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্য উৎপাদন করতে হবে। প্রয়োজনে দেশের নির্দিষ্ট স্থানে 'রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন অঞ্চল' প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যান্য কৃষিপ্রধান দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ অত্যন্ত কম। কৃষির টেকসই উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একটি কম্বাইন হারভেস্টারের দাম সাড়ে ৭ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এত টাকা খরচ করে কৃষি যন্ত্রপাতি কেনা সাধারণ কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য রাইস ট্রান্সপস্নান্টার ও কম্বাইন হারভেস্টারের মতো কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো কৃষক যাতে সুলভ ভাড়ায় ব্যবহার করতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা উচিত এই বাজেটে।

কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো ধীরে ধীরে কৃষি থেকে শিল্পের দিকে যেতে হবে আমাদের। কৃষি থেকে আসবে শিল্পের কাঁচামাল। কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির জোগান দিবে দেশে স্থাপিত শিল্প-কারখানা। এতে কৃষির সঙ্গে শিল্পের গড়ে উঠবে এক সুদৃঢ় সেতুবন্ধন। আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ২০৪১ সালের মধ্যে পরিণত হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি উন্নত দেশে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্‌ লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<53730 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1