বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লিচুর ক্ষতিকর পোকা মাকড় দমনে করণীয়

দেশের সব লিচু উৎপাদনকারী এলাকায় গাছের নরম অংশ যেমন- বর্ধনশীল ডগা, পাতা ও ফলের বোঁটা এবং কচি ডালের কোষের রস চুষে খাচ্ছে। ব্যাপক আক্রমণে বাড়ন্ত ফল ও ডগা শুকিয়ে যায় ফলে গাছে কম ফল ধরে।
নতুনধারা
  ০৯ জুন ২০১৯, ০০:০০

কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম/

কৃষিবিদ মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ

লিচুর গান্ধিপোকা একটি গৌণ ক্ষতিকর পোকা। তবে লিচু উৎপাদনকারী দেশে এটি আস্তে আস্তে মুখ্য ক্ষতিকর পোকা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ইংরেজিতে একে ঝঃরহশ ইঁম বলা হয়। লিচুর গান্ধিপোকা বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, তার মধ্যে ঞবংংধৎধঃড়সধ লধাধহরপধ (ঞযঁহনবৎম) এ প্রজাতিটি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রজাতির গান্ধিপোকা রয়েছে- যা লিচু গাছে আক্রমণ করে থাকে। এ প্রজাতিটি অস্ট্রেলিয়া, চায়না, ভারত, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে বেশি ক্ষতি করছে। দেশের সব লিচু উৎপাদনকারী এলাকায় গাছের নরম অংশ যেমন বর্ধনশীল ডগা, পাতা ও ফলের বোঁটা এবং কচি ডালের কোষের রস চুষে খাচ্ছে। ব্যাপক আক্রমণে বাড়ন্ত ফল ও ডগা শুকিয়ে যায় ফলে গাছে কম ফল ধরে। অনেকগুলো পোকা যখন বাড়ন্ত ফলে জমাট বেঁধে আক্রমণ করে তখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফল ঝরে পড়ে। কাঠলিচু, রাম্বুটান, গোলাপ, ডালিম, ইউক্যালিপটাস, জাম্বুরা এর বিকল্প পোষক। এরা সাধারণত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেখা দেয় আর আগস্টের শেষ সপ্তাহে পূর্ণ বয়স্ক পোকাগুলো শীতনিদ্রায় চলে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ পোকা ফেব্রম্নয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। এ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন লিচু উৎপাদনকারী এলাকা যেমন- পাবনা, দিনাজপুর এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে বলে মাঠ থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ন্ত লিচু রস চুষে খাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে এবং আক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেলে ফল শুকিয়ে ঝরে পড়ছে।

ক্ষতিকর এ পোকার স্ত্রী পোকাগুলো পাতার নিচের দিকে গোলাকার ফ্যাকাসে গোলাপি বর্ণের ১০-১২টি ডিম গুচ্ছ আকারে পড়ে থাকে। ডিম, নিম্ফ (বাচ্চা কীড়া) ও পূর্ণাঙ্গ পোকা এ তিনটি স্তরে লিচুর গান্ধিপোকা জীবনচক্র সম্পন্ন করে। নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ পোকা রস চুষে খেয়ে লিচু গাছের ক্ষতি করে থাকে। নিম্ফ বা বাচ্চার পাঁচটি স্তর দেখা যায়। নিম্ফের প্রথম স্তর দেখতে প্রায় অর্ধ আয়তাকার বাদে বাকি চারটি স্তরই গাঢ় লাল এবং অর্ধ আয়তাকার দেখতে হয়ে থাকে। পুরুষ পোকা ৪৩-৪৫ দিন আর স্ত্রী পোকা ৪৭-৪৮ দিন বেঁচে থাকে। সদ্য ফোটা নিম্ফ (বাচ্চা) ময়লাটে সাদা এবং নরম দেহের পোকা কিন্তু পোকার রং কয়েকদিনের মধ্যেই হলদে-লাল হতে শুরু করে। স্ত্রী পোকাগুলো বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং আক্রমণ তীব্র হলে লিচুর ফলন শতকরা ৮০ ভাগের বেশি কমিয়ে দিতে পারে।

গান্ধিপোকার দমন ব্যবস্থাপনা

শীতকালে গাছকে ঝাঁকিয়ে পোকা সংগ্রহ করে কেরোসিনে ডুবাতে হয়, কিন্তু এটি অল্প জায়গায় ছোট গাছের জন্য প্রযোজ্য। গান্ধিপোকার ডিম গুচ্ছ আকারে দেখা গেলে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। এ পোকার ডিমে সর্বোচ্চ শতকরা ৭০-৯০ ভাগ পরজীবিতা দেখা দিলেও গড়ে সাধারণত শতকরা ২-৩ ভাগ পরজীবিতা লক্ষ্য করা যায়। সমন্বিতভাবে দমনের ক্ষেত্রে অহধংঃধঃঁং নধহমধষড়ৎবহংরং  ও ঙড়বহপুৎঃঁং ংঢ়. এ দুই প্রজাতির বোলতা ডিম পরজীবিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাচ্চা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকা দমনে কিছু কিছু ছত্রাক, পাখি এবং লাল পিঁপড়া জৈবিক দমনে সাহায্য করে থাকে বলে জানা যায়। যে কোনো ভালোমানের অন্তর্বাহী বালাইনাশক লিচুর গান্ধি নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও বালাইনাশক ও এর মাত্রা নির্ধারণে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কার্বারিল গ্রম্নপের সেভিন/এসিকার্ব এক লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে অথবা ক্লোরোপাইরিফস গ্রম্নপের ডারসবান/মর্টার/এসিমিক্স/নাইট্রো এক লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে যে কোনো একটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা যায়, স্প্রেকৃত রাসায়নিক বালাইনাশকের কার্যকারিতা বছরের বিভিন্ন সময় দেহের ফ্যাটের ওপর নির্ভর করে।

ফল ছিদ্রকারী পোকার দমন ব্যবস্থাপনা

এ পোকা ফলের বোঁটার কাছে ছিদ্র করে এবং ভেতরে ঢোকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। পরে ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় এবং বাজারমূল্য কমে যায়। প্রতিকার ব্যবস্থা হলো- লিচু বাগান নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুঁতে ফেলা। লিচু গাছ তলায় শুকনো খড়ে আগুন দিয়ে তাতে ধুপ দিয়ে ধোঁয়া দিতে হবে। এতে এ পোকার মথ বা কীড়া বিতড়িত হবে। ফলে লিচুর মধ্যে ডিম পারবে না। বোম্বাই জাতে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয় তাই আক্রমণপ্রবণ এলাকায় চায়না-৩ জাত রোপণ করা। এ ছাড়া নিম তেল বা নিমকবিসিডিন (০.৪%) পানিতে গুলে স্প্রে করে দেখা যেতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে ২ মিলি লেবাসিড বা সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।

লিচুর মাইট পোকার দমন ব্যবস্থাপনা

পূর্ণ বয়স্ক ও বাচ্চা মাকড় একটি শাখার কটি পাতায় আক্রমণ করে ও পাতার রস চুষে নেয়। ফলে আইরিনিয়াম নামক বাদামি রংয়ের মখমলের মতো এক ধরনের আবরণ তৈরি হয়। প্রতিকারের জন্য লিচু বাগান নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। পাতা ভেতরের দিকে কুঁকড়িয়ে গিয়ে শেষে আক্রান্ত পাতা শুকাতে থাকে। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলা। (জুন ও আগস্ট) জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা যেমন নিমবিসিডিন (০.৪%)। মধ্য ভাদ্র হতে কার্তিক মাস এবং মাঘের শেষ হতে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত গাছে ২/৩ বার মাকড়নাশক ব্যবহার করা যেমন ওমাইট ২ মিলি বা ২ গ্রাম থিওভিট বা কুমুলাস বা রনভিট প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা।

মিলিবাগ পোকার দমন ব্যবস্থাপনা

এরা পাতার রস ও ডালের রস চুষে নেয় ফলে গাছ দুর্বল হয়। পোকার আক্রমণ পাতা ও ডালে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। অনেক সময় পিঁপড়া দেখা যায়। প্রতিকার ব্যবস্থা হলো- আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছাঁটাই করে ধ্বংস স্বচ্ছ ১৫.২০ সেমি উপরে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা মুড়ে দিতে হবে যাতে মিলিবাগ গাছে উঠতে না পারে। সম্ভব হলে হাত দিয়ে ডিম ও বাচ্চার গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা। জৈব বালাইনাশক নিবিসিডিন (০.৪%) ব্যবহার করা। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি রগর, টাফগর, সানগর বা সুমিথিয়ন এবং ১.৫ মিলি মিপসিন বা সপসিন মিশিয়ে স্প্রে করা।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে ক্ষতিকর এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই লিচু বালাই ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট গবেষকদের জন্য নিকট ভবিষ্যতে কার্যকর সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনে সতর্ক বার্তা বহন করে। অন্যথায় বাংলাদেশের সুস্বাদু এ ফল উৎপাদনকারী চাষি এবং একই সঙ্গে লিচু বাণিজ্যে জড়িত সংশ্লিষ্ট সবার জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এসব পোকা-মাকড়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<52668 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1