শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমৃদ্ধ চর উন্নত দেশ

আবুল বাশার মিরাজ ও এ কিউ রাসেল
  ২৬ মে ২০১৯, ০০:০০
চরে উৎপাদিত মরিচ চরেই শুকান কৃষকরা

চরে বসবাসরত প্রায় অর্ধকোটি মানুষ প্রতিনিয়তই লড়াই করছে নদীর সঙ্গে। নিত্য তারা লড়াই করছে নদীর নিষ্ঠুর ভাঙনের সঙ্গে। আরও রয়েছে ঋতু পরিবর্তনের খেলা। এসব ছাপিয়েও চর হচ্ছে কৃষির অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। আর এখানেই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে পলস্নী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) অন্তর্ভুক্ত চর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (সিডিআরসি)। সম্প্রতি ইউটিউবে এমন একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখে উদ্বুদ্ধ হই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এটি বাংলাদেশ সরকার ও এসডিসির অর্থায়নে মে ২০১৩ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ মেয়াদি একটি বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট কারিগরি সহায়তাধর্মী চলমান প্রকল্প। আর চরের মানুষের উঠে আসার গল্পগুলোই তুলে ধরা হয়েছে প্রামাণ্য চিত্রটিতে। ফিল্ম ক্যাসল ওয়াল্ডওয়াইড লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা মো. মহিউদ্দিন মোস্তফা। নির্মাতা বলেন, 'চরের মানুষের নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি চরে থেকেছি, তাদের সমস্যাগুলো কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করেছি। সেগুলোই ক্যামেরার পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।'

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, 'সমৃদ্ধ চর, উন্নত দেশ' এই স্স্নোগানকে সামনে রেখে ফুলছড়ি, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর এবং কাজিপুর, সিরাজগঞ্জে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ইকো পার্কে সিডিআরসি ও মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি যমুনা, পদ্মা, এবং তিস্তা চর (এমফোরসি) প্রকল্পের সহযোগিতায় চর কৃষি ও বাণিজ্যমেলাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। চর এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার সার্বিক মানোন্নয়ন এবং বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য ও প্রযুক্তিশিল্পের মূলধারার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চরের বাজারের ব্যবসায়িক সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরাই ছিল এই মেলার মূল লক্ষ্য। চারটি কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্চ/১৮- জানুয়ারি/১৯ মাস পর্যন্ত চরাঞ্চলে সর্বমোট ৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মূল্যের মানসম্মত কৃষি উপকরণ বিক্রি করেছে। তাদের পণ্য বেশি পরিমাণ বিক্রির লক্ষ্যে ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৪১টি কৃষক সভা, ৬৩টি কৃষক প্রচারাভিযান পরিচালনা করে যেখানে মোট ১৬ হাজার ২৩৩ জন কৃষক উপস্থিত ছিলেন। যার মধ্যে ৬ হাজার ৭৫২ জন নারী। তারা গোখাদ্য সরবরহকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই গোদরেজ মার্চ/১৮- জানুয়ারি/১৯ মাস পর্যন্ত চরাঞ্চলে ১ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন উন্নতমানের গবাদিপশুর খাদ্য বিক্রয় করেছে। এ ছাড়া দশটি ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ এবং ১২৭টি কৃষক প্রচারাভিযান পরিচালনা করেছে। যেখানে ১১ হাজার ৭৭৪ জন কৃষক উপস্থিত ছিলেন। যার মধ্যে ৬ হাজার ৮০৯ জন ছিলেন নারী। এ ছাড়া ৫টি গবাদি প্রাণীর টিকা প্রদান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। যেখানে ৪৩৫টি পরিবারের গবাদি প্রাণীকে টিকা প্রদান করা হয়।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে পলস্নী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত সচিব মো. আমিনুল ইসলাম চরের উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, কৃষিব্যবস্থাকে আরও উন্নতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে বিভিন্ন সেক্টরে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের দিকে নজর দিয়েছেন। আমাদের গবেষণা দল এবং দক্ষ মাঠকর্মীরা চরকে কৃষিবান্ধব করতে, টেকসই বাজারব্যবস্থাপনা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। চরাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের (ভুট্টা, মরিচ, পাট) উৎপাদন ও উৎকর্ষতা সাধনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে উন্নত জাত, উৎপাদন পদ্ধতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণের কাজ করে যাচ্ছি।'

যমুনার বালুতে গুপ্তধন

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার যমুনা নদীর গর্ভে বিস্তীর্ণ এলাকা। বর্ষায় দুই কূল ভাসিয়ে নেয়া যমুনা শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচর। যমুনার বুকে জেগে ওঠা বালুচর অবহেলিত মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম একমাত্র অবলম্বন। রাক্ষুসে যমুনার ভাঙাগড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষ বালুচরে দীর্ঘদিন ধরে চীনা বাদামের চাষ করে আসছে। চলতি মৌসুমে বাদামের দাম ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। তাই চরের কৃষক বাদামকে আদর করে নাম দিয়েছেন গুপ্তধন।

সরেজমিন যমুনার চর ঘুরে দেখা গেছে, যমুনা নদীর বুকজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় চর। আর এসব বালুচরে মাইলের পর মাইল চীনা বাদামের ক্ষেত। সাদা বালুর জমিনে সবুজ আর সবুজে ছেয়ে গেছে লতানো বাদামেরগাছে। প্রতিটি লতানো বাদামগাছের মুঠি ধরে টান দিলেই উঠে আসছে থোকা থোকা সোনালি রঙের চীনা বাদাম। এ যেন বালুর নিচে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধন। বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগেই গুপ্তধন ঘরে তুলতে ব্যস্ত শত শত কৃষক। চলতি মৌসুমে বাদামের দাম ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। তাই চরের কৃষক বাদামকে আদর করে নাম দিয়েছেন গুপ্তধন।

ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা চরের কৃষক আজমত আলী জানান, যমুনা চরের বালু মাটি চীনা বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ বছর বাদাম চাষ করে অনেক লাভ হবে বলে আশা করছি। প্রতি মণ কাঁচা বাদাম বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকায় এবং প্রতি মণ শুকনা বাদাম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। এবার ফলন ভালো হওয়ায় এক বিঘা জমিতে ০৮ থেকে ১০ মণ বাদাম পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাদামের ফলনও হয়েছে। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বিঘায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হবে।

আরেক কৃষক হোসেন মিয়া জানান, বালু মাটিতে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করে বাদামের সমপরিমাণ লাভ হয় না। অন্যান্য ফসল উৎপাদনের চেয়ে চীনা বাদাম উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় চরাঞ্চলের আমরা সবাই বাদামের চাষ করেছি। বাদাম রোপণের পর অন্য ফসলের মতো কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। নেই রাসায়নিক সারের ব্যবহার। বীজ রোপণ আর পরিপক্ব বাদাম উঠানোর লেবার খরচ ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই বললেই চলে। একটি ফসলেই আমাদের সারা বছরের সংসার চলে। বালুচরের এ ফসলটি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য গুপ্তধন।

ভূঞাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জিয়াউর রহমান বলেন, গতবছর যমুনার চরে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছিল। এবছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমিতে ঢাকা-১ ও ডিজি-২ জাতের চীনা বাদামের চাষ হয়েছে। আমরা আশা করছি যমুনার চরে বাদামের ব্যাপক চাষাবাদ কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কৃষকদের সব সময় আমরা সচেতনমূলক পরামর্শ দিয়ে থাকি এবং কোনো রোগ হলে তাৎক্ষণিক উপ-সহকারী কৃষি অফিসারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<51128 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1