বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বোরোর ফলন বাম্পার দাম নিয়ে হাহাকার

আফরোজা চৌধুরী
  ১৯ মে ২০১৯, ০০:০০

আবহমানকাল থেকে বাংলার কৃষি, কৃষ্টি, লোকাচার, খাদ্যাভাস, ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের সবকিছুই ধানকেন্দ্রিক। জিডিপির হিসাবে দেশের অর্থনীতিতে ধানের অবদান এক অঙ্কের কোঠায় হলেও অভ্যন্তরীণ নির্ভরশীলতার বিচারে এর ওপরই আমরা দাঁড়িয়ে। বিগত ৪৮ বছরে ধানের উৎপাদন সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে এবং উদ্বৃত্ত ধান-উৎপাদক দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ধান-চালের দামের স্পর্শকাতরতার দরুন এ বিপুল অর্জন প্রায়ই ম্স্নান হয়ে পড়ছে।

জীবনযাত্রার মান হোক বা মুদ্রার মূল্যায়ন; ধানের দাম যুগে যুগে পরিমাপের স্কেল হিসেবে দারুণ গ্রহণযোগ্য। শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে আজ অব্দি রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রনায়কের দেশ চালনার সদিচ্ছাও আমরা মেপে দেখি বাজারে ধান-চালের দামকে ঘিরে। বিশ্বের ধনাঢ্য দেশগুলোর মতো আমাদের অর্থনীতি মরণাস্ত্র বা তেল বাণিজ্যভিত্তিক নয়, অত্যাধিক জনসংখ্যার পেট চালিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে আমাদের আনাগোনা এখনো গ্রামীণ প্রবাদ : যার গোলায় নাই ধান, তার আবার কথার টান' পর্যন্তই। কারণ কেবল এক মৌসুমে বাংলাদেশে বিশ্বের প্রধানতম রাজনৈতিক পণ্য ধানের উৎপাদন বন্ধ থাকলে পৃথিবীর কোনো দেশ (টাকার বিনিময়েও) আমাদের খাদ্য জোগান দিতে আসবে না। ২০০৭-০৮ সালে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের খাদ্য-স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন বিস্ময়ের এক উপাখ্যান, যা সাধিত হয়েছে ধান-চাষি, কৃষি শ্রমিক, জাত উদ্ভাবক, সম্প্রসারণকর্মী, বিশেষজ্ঞ গবেষক, সরকারি নীতিসহায়তা এবং অগণিত মানুষের কঠোর শ্রম, ঘাম, মেধা ও মননের মাধ্যমে। তবু এ সেক্টরের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের মধ্যে প্রতিনিয়ত শঙ্কা কাজ করে। একদিকে কৃষকপর্যায়ে ফলন, খরচ, লাভজনকতা নিয়ে শঙ্কা, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণের মধ্যে থাকে দাম ও মান নিয়ে শঙ্কা। ন্যায্য দামের নিশ্চিত গ্যারান্টি না দিতে পারায় যেটুকু প্রাপ্তি তা সোনালি উদ্ভাস এনে দেয় কেবল মাঠকে, না কৃষক না ভোক্তা এর সুফল পকেটে পুরতে পারছেন। দাম না পাওয়ায় নিরুৎসাহিত হয়ে ধান চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন কৃষক সমাজ, যা ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও কূটনৈতিক অবস্থানকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। কেন গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি দামের প্রশ্নে এতটা স্পর্শকাতর? এবং এর শেষ রক্ষায় করণীয় কী?

সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় আমন ও বোরো মৌসুমে ধান-চালের ক্রয়মূল্য ঘোষণা করে থাকে। ঘোষিত মূল্যে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান-চাল ক্রয় করে। খাদ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি আমন ও বিগত বোরো মৌসুমে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যথাক্রমে ৭,৯৯,৯৬৬ মেট্রিক টন ধান ও ১৩,৯৫,৪২৬ মেট্রিক টন চাল ক্রয় করেছে যা মৌসুমভিত্তিক মোট উৎপাদনের ৫.৭% ও ৭.১%। আউশ উৎপাদনে ইদানীং সরকার বেশ জোর দিলেও এ মৌসুমে উৎপাদিত ধান-চাল ক্রয়ের/সংগ্রহের আওতাভুক্ত নয় এবং এর ক্রয়মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয় না। অর্থাৎ তিন মৌসুমে উৎপাদিত ধান-চালের আনুমানিক ৯৫ ভাগ সরকারি সংগ্রহ অভিযানের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি এবং তা খোলা বাজারে কেনাবেচা হয়ে থাকে। খোলা বাজারে সরকারি দাম কেউ মানছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব কৃষি বা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এ দায়িত্বটি তাহলে কার! রাষ্ট্রযন্ত্রের কেউ কি সে দামের যৌক্তিকতা তদারকি করছে? কোনো ক্রেতা বিক্রেতা পক্ষ ইচ্ছা-স্বাধীন দামে কেনাবেচা করলে প্রচলিত আইনে তার কোনো শাস্তির বিধান আছে কি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি নেতিবাচক হয় তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ব্যবসায়ীদের নীতিবোধের কাছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে নিছক গলাবাজি ফলদায়ী হবে আশা করা কতটা উচিত?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাইস সেক্টরে ঘটে যাওয়া ঘটনা, দুর্যোগ, দামের বিভিন্ন নজির ও সরকারি পদক্ষেপ পর্যালোচনা করা যাক। তার আগে এ সেক্টরের সঙ্গে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা বাজার প্রভাবিত করে, সেগুলো আলোকপাত করি। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব ছোটখাটো ধান ব্যবসায়ী কাম সার্ভিস প্রোভাইডার্স রয়েছে, এদের সংখ্যা ও ধানের হাতবদলকে দায়ী করে অনেকেই রাইস ভ্যালু চেনের গলদ বের করেন কিন্তু বস্তুত বিষয়টি তার চেয়ে কিছুটা জটিল। দেশের কৃষি পরিবারগুলোর শতকরা ৮৪ ভাগ ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত যারা পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য ধান উৎপাদন করে থাকে। বিশেষত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা অর্থকরী বোরো ধান আবাদের আগে সারের জোগানদাতা, সেচ পাম্পের মালিক ও মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে এবং চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সার, বীজ, সেচের পানি সংগ্রহ করে থাকে। ধান মাড়াইয়ের পর পরই এসব পাওনা পরিশোধ করতে হয়, পরিবারের চাহিদা মেটাতে হয় ও পরবর্তী ফসলের প্রস্তুতি নিতে হয়। এ কারণে দেশীয় বাজারে ধান কাটা মৌসুমে যা কেনাবেচা হয় তা মূলত কৃষক কর্তৃক 'যা পাই তাই' দামে ছেড়ে দেয়া ভেজা ধান। আর একই শীষ থেকে উদ্ভব হলেও বাজার রূপ বিবেচনায় ধান ও চাল দুটি আলাদা পণ্য। ধানের শেষ গন্তব্য চাতালের কল এবং আমি আপনি এর ক্রেতা নই। অন্যদিকে, চাল হচ্ছে নিতান্তই একটি মেশিন আউটপুট যার দাম (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নামও) ইনপুটের ওপর সামান্যই নির্ভর করে। এ দুটি ভিন্ন পণ্যের বেলায় চাতাল মালিক বা অটোরাইস মিলার একজন কমন স্টেক হোল্ডার যে সুযোগ পায় ধান আর চালের দামের পার্থক্যটুকু ট্রান্সলেট করে নিজের কাছে রেখে দেয়ার। যদিও ভেজা ধান শুকিয়ে, ভাঙিয়ে গুদামজাত করতে তাকেই শ্রম, সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। প্রতি মৌসুমে বড় ব্যবসায়ী ও রাইসমিলারদের কিছু আগাম প্রস্তুতি এবং দামের সমীকরণ সেট করা থাকে।

চলতি বছরের বোরো মৌসুমের বাম্পার ফলন কৃষকের গোলায় উঠতে শুরু করেছে। প্রাথমিক হিসাবে ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবলে সামান্য কিছু জমির ফসলের ক্ষতি হলেও, এবারও উৎপাদন রেকর্ড ছাড়াবে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের। বাজার নিয়ন্ত্রণে রপ্তানি সম্ভাবনা যাচাইয়ের গুঞ্জন ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো নতুনত্ব বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ গৃহিত হয়নি। অবশ্য বৈশ্বিক চাল রপ্তানি বাজারে প্রবেশের আগেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে বিস্তর হোম ওয়ার্ক করা প্রয়োজন, নইলে সেখানেও আমরা প্রাইস টেকার হতে পারবো না। হুট করে ঢোকার আগে চালের 'বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অ্যাস্টাবিস্নশিং' দরকার এবং মানের দিক থেকে বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করতে সাপস্নাই চেন ডেভেলপ করা দরকার।

পরিশেষে বলা দরকার, একই শীষ থেকে উদ্ভব হলেও বাজার রূপ বিবেচনায় ধান ও চাল দুটি আলাদা পণ্য এবং অভিন্ন মূল্যনীতি দিয়ে এ দুটির বাজারকে বশে রাখা দুষ্কর। এমন যদি হতো, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক তার ফলানো ধান নিজ ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছে দিতেই ডিজিটাল ডেটাবেজ আগের সব বাকি-বকেয়া বিয়োগ করে পাওনার হিসাব করে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ধানের দামের প্রথম কিস্তির টাকা তুলতে পারছে কৃষক। এমন যদি হতো, প্রতিটি উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার পাশাপাশি 'কৃষি বিপণন কর্মকর্তা'র পদসৃষ্টি করা হয়েছে যে তার দলবল সমেত মাঠের সঙ্গে বাজারের সমন্বয় সাধনের কাজটি করছেন ধানসহ সব কৃষিপণ্যের জন্য। এমন যদি হতো, দেশজ উৎপাদনের একটি বড় অংশ (অন্তত ত্রিশ শতাংশ) পাবলিক প্রোকিওরমেন্টের আওতায় চলে এসেছে, যেখানে ভেজা ধান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় মেশিনে শুকিয়ে গুদামজাত করা হচ্ছে। এমন যদি হতো, পিপিপির আওতায় দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে ধানের বাই-প্রোডাক্ট থেকে পাওয়া ব্র্যান ওয়েল, জ্বালানি, মোম, ফিস অ্যান্ড পোল্ট্রি ফিড ও সিমেন্ট শিল্পের মতো নানা ধরনের এন্টারপ্রেনিওরশিপ যার লভ্যাংশ কৃষকের অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে দামের শেষ কিস্তি হিসেবে। এমন যদি হতো, আমদানি শুল্কের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সার্কিট ব্রেকার। সরকারি মজুদ কমে গেলে, মোটা চালের দাম অল্প আয়ের মানুষের নাগালের ওপরে বা কৃষকের লাভজনক মূল্যের নিচে নেমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুল্ক বেড়ে-কমে যাচ্ছে। এমন যদি হতো, ট্রাকের পাশাপাশি শহর-বন্দরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে কম দামে চাল বিক্রির ওএমএস সুপারশপ রয়েছে যেখানে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চাল কিনতে পারছেন মধ্যবিত্ত ও চাকুরে শ্রেণির সামাজিক মর্যাদাবানরা। এমন যদি হতো, বর্ডার পুশ-ইন, চাল কেটে ভিন্ন নামে বিক্রি, পরিবহনে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সব অনিয়ম চলে এসেছে কঠোর নজরদারির ভেতর। এমন যদি হতো, ধান-চালের জন্য পৃথক একটি 'ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ কমিশন' রয়েছে যেখানে সরেজমিন মাঠ ও বাজার পর্যবেক্ষণ ইউনিটের পাশাপাশি রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার ক্ষমতা। আশা করতে দোষ কী! এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের আবেদনের কাছে যেভাবে প্রতিনিয়ত ম্স্নান হয়ে যায় আমাদের ডায়েট পস্ন্যানের ক্যালোরির হিসাব কিংবা বেহাল মহাসড়কে ধানের চারা যেভাবে হয়ে যায় প্রতিবাদের ভাষা, ঠিক তেমনিভাবে ধানের দামের পরিভাষায় উন্নয়নের কাহন রচিত হোক, পদ্মা সেতুর স্প্যানের চেয়েও প্রগাঢ় হোক কৃষকের হাসি।

লেখক : গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50019 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1