বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোরো ধানের জরুরি পরিচযার্

ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা এবং সারের কাযর্কারিতা বৃদ্ধির জন্য কোন সার কখন ও কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা নিধার্রণ করা...
কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

ভালো ফলনের জন্য সুষম সারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকাযর্। সার প্রয়োগ করতে দুটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখা দরকার। প্রথমত, ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা। দ্বিতীয়ত, সারের কাযর্কারিতা বৃদ্ধির জন্য কোন সার কখন ও কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা নিধার্রণ করা। সার ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন ও আথির্কভাবে লাভবান হওয়াই সবার কাম্য। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারের মাত্রা নিণর্য় করা সবোর্ত্তম। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় সার সুপারিশ গাইড অনুযায়ী কিংবা অনলাইনে সার সুপারিশ নিদেির্শকা সফটওয়্যার (ঋজঝ) ব্যবহার করেও সারের মাত্রা জানা যায়। অনলাইনে সার সুপারিশ পাওয়ার জন্য িি.িভৎং-নফ.পড়স লিখে সাচর্ দিয়ে সামান্য কিছু তথ্য পূরণ করলেই যে কেউ-ই তার জমিতে নিদির্ষ্ট ফসলে কাক্সিক্ষত সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি জানতে পারবেন। এ জন্য সরকারি কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে বা কৃষক বন্ধু সেবার ৩৩৩১ নম্বরে কল করে, বøকের উপসহকারী কৃষি অফিসার, ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত ফিয়াক সেন্টার কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে যোগাযোগ করে হাতের কাছে সরাসরি সহযোগিতা পাওয়া যাবে।

সার ব্যবস্থাপনা : সাধারণভাবে ১৫০ দিনের নিচে স্বল্পমেয়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪, ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮ ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বা বিনা ধান-১০ এবং বিনা ধান-১৮ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অথার্ৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৩৫ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম বা গন্ধক ১৫ কেজি, দস্তা (মনোহাইড্রেট) ১.৫ কেজি। ১৫০ দিনের বেশি দীঘের্ময়াদি জাত যেমন- ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮ বা ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৮৯ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি অথার্ৎ প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১৩ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ১৫ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। হাওর অঞ্চলের জাতের ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩ শতকে সারের মাত্রা ইউরিয়া ২৭ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২২ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি, দস্তা ১.৫ কেজি। তবে টিএসপির বদলে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে।

সার প্রয়োগের পদ্ধতি : টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। সতকর্ থাকতে হবে দস্তা ও টিএসপি একসাথে না মিশিয়ে পৃথকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে। দীঘের্ময়াদি জাতের ক্ষেত্রে ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর অথার্ৎ গোছায় কুশি দেখা দিলে এবং শেষ কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে। সার প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আরও কিছু পরামশর্ মেনে চলতে হবে।

জৈব সারের গুরুত্ব : জমিতে পযার্প্ত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারের সঙ্গে রাসায়নিক সার সমন্বয় করে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের কাযর্কারিতা বৃদ্ধি পায় ও ভালো ফলন হয়। জমিতে বছরে একবার হলেও বিঘাপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। আমন মৌসুমে যে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করা হবে সে জমিতে বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সার নিধাির্রত মাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ কম ব্যবহার করতে হবে। টিএসটি ও এমওপি সার অধের্ক মাত্রায় ব্যবহার করলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ধান কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ১০-১২ ইঞ্চি উপরে কেটে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে দিলে পটাশ সারের পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগ কম লাগে।

দস্তা বা জিঙ্ক সালফেট সার ফসলচক্রের কোনো একটিতে ব্যবহার করলে তা পরবতীর্ দুই ফসলের জন্য ব্যবহার না করলেও চলবে। বেলে মাটিতে চার কিস্তিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করাই ভালো। জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো ফলন আশা করা যায়। তীব্র শীতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না। ইউরিয়া সারের অপচয়রোধে এবং ইউরিয়া সারের কাযর্কারিতা বাড়াতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য এক মৌসুমে প্রতি চারটি গোছার জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি মেগাগুটি প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। যদি কোনো কারণে গন্ধক বা দস্তা ব্যবহার করা না হয় তাহলে গাছের গন্ধক বা দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ বুঝে সার দিতে হবে।

পানি ব্যবস্থাপনা : এবারে বোরো ধানে সেচের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা। মনে রাখতে হবে ধানগাছ কোনো জলজ উদ্ভিদ নয় তবে পানি বেশি পছন্দ করে। এজন্য সারাক্ষণ পানিতে ভাসিয়ে জমি টইটম্বুর করে রাখা ঠিক নয়। পানি বেশি হলে বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ, রোগের জীবাণু ছড়ায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যহৃত হয়, ফুল/ফল ঝরে পড়ে ও দানা পুষ্ট হয় না। পরিশেষে ফলন কম হয়। আবার অন্যদিকে পানি কম হলে খাদ্য গ্রহণ বা পরিবহনে ব্যাহত হয়, খাদ্য তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়, গাছ মরে যেতে পারে, ফুল-ফল দেরিতে আসে, আগাছা বেশি হয় এবং দানা পুষ্ট হয় না। ফলে ফলন কম হয়। ধানে বৃদ্ধির কোন পযাের্য় কী পরিমাণ পানি লাগে আসুন তা জানা যাক। চারা লাগানোর সময় ছিপছিপে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি লাগে। এর কম বা বেশি হলে রোপণে অসুবিধা হয়। চারা লাগানোর থেকে পরবতীর্ ১০ দিন পযর্ন্ত দেড় থেকে দুই ইঞ্চি। পানি কম হলে রোপণ ঝঁুকি সামলে উঠতে বেশি সময় লাগে আর বেশি হলে চারা হেলে পড়ে। চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পযর্ন্ত এক থেকে দেড় ইঞ্চি। এর কম বা বেশি হলে কুশি কম হয়। কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পযর্ন্ত দুই থেকে চার ইঞ্চি। এ সময় রসের ঘাটতি হলে দানা গঠন পুষ্ট হবে না, দানার সংখ্যা কম হবে। আর পানি বেশি হলে গাছ দুবর্ল হয়ে যেতে পারে। ধানে দানা শক্ত ক্ষীর হলে অথার্ৎ ধান কাটার ১০-১২ দিন আগ পযর্ন্ত পযার্য়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে।

পানি সাশ্রয়ী এডবিøউডি : বোরো মৌসুমে ধান আবাদে খরচের অন্যতম প্রধান খাত হলো সেচ। আগামীতে সেচের খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। পানি সাশ্রয়ী একটি কাযর্কর পদ্ধতির নাম পযার্য়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি বা এডবিøউডি। জমিতে একটি পযের্বক্ষণ পাইপ বা চোঙ বসিয়ে সহজেই সেচ দেয়ার সময় নিধার্রণ করা যায়। গভীর নলক‚পে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণ করা হলে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অপচয় রোধ করা যায়, সময় শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে, উঁচু-নিচু জমিতে সহজেই পানি বিতরণ করা সম্ভব। এর ফলে সেচ এলাকা শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। নিশ্চিত বোরো মৌসুমকে ঘিরে সঠিকভাবে সার ও সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করুন এবং গোলা ভরা ফসল ঘরে তুলুন।

বালাই ব্যবস্থাপনা : ধানের জমিতে সেচের মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে লেদা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, কাটুই পোকা, ওড়চুঙ্গা আর রোগের মধ্যে বøাস্ট, বাদামি দাগ এবং অধিকাংশ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যদিকে নিষ্কাশন বা পানি সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে পোকামাকড়ের মধ্যে পাতা মাছি, চুংগী পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সাদাপিঠ গাছফড়িং, রোগের মধ্যে বিভিন্ন ছত্রাক রোগ, পাতা পোড়া রোগ এবং আগাছার মধ্যে শেওলা, পানিকচু, কচুুরিপানা বা চেঁচড়া জাতীয় আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

লেখক : পিএইচডি ফেলো, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36987 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1